ঝুমু খালা একটু এগিয়ে তার ব্যাগটা নিচে রেখে, শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে নিল। ঝুমু খালার চেহারার মাঝে সবসময় একটা তেজি ভাব থাকে, শাড়ির আঁচল কোমরে প্যাচিয়ে নেওয়ার পর তেজি ভাবটা কেমন যেন একশ’ গুণ বেড়ে উঠল। ঝুমু খালা একজন বয়স্কা মহিলার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “মা, ঝর্ণা কই?”
টুনি বুঝতে পারল এই বয়স্কা মহিলাটা ঝুমু খালার মা। ঝুমু খালাকে দেখে কেমন জানি ভয় পেয়ে গেছে, দুর্বল গলায় বলল, “ভিতরে। ঘরের ভিতরে।”
“গলায় কি দড়ি দিছে, নাকি এখনো দেয় নাই?”
“এইটা তুই কী বলিস, গলায় দড়ি দিবে কেন?”
“গলায় দড়ি দিব কেন তুমি বুঝ নাই? ঝর্ণারে তুমি কি আসলেই পেটে ধরছিলা, সত্যি করে কও দেখি?”
ঝুমু খালার মা কেমন জানি থতমত খেয়ে বলল, “ঝুমু, কী রকম কথা বলিস তুই?”
ঝুমু খালা এবারে ঘরের দিকে এগিয়ে গলা উঁচু করে ডাকল, “ঝর্ণা, এই ঝর্ণা। বাইরে আয়।”
টুনি তখন দেখল ঘরের ভেতর থেকে তার চাইতে একটু বড় একজন মেয়ে প্রায় ছুটে বের হয়ে এসে ঝুমু খালাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ঝুমু খালা ঝর্ণাকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, “কান্দিস না বোকা মেয়ে। মেয়ে হয়ে যখন জন্ম হইছে তখন কান্দাকাটি বন্ধ কর। গলায় দড়ি দিবি তো বল, তোরে দড়ি কিনে এনে দেই।”
ঝুমু খালা এদিক-সেদিক তাকাল। এক পাশে দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, ঝুমু খালা তাকে ডাকল, বলল, “এই জহুরুল। শোন।”
জহুরুল এগিয়ে এলো। ঝুমু খালা বলল, “পাকঘরে যা, গিয়া দা’টা নিয়ে আয়।”
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, “দা?”
“হ্যাঁ।”
ঝুমু খালার মা বলল, “দা কেন? দা দিয়ে কী করবি?”
ঝুমু খালা তার মায়ের কথা শুনল বলে মনে হলো না, ছেলেটাকে একটা ধমক দিয়ে বলল, “কী বললাম তোরে! কথা কানে যায় না? দৌড় দে।”
ছেলেটা এবারে সত্যি সত্যি একটা দৌড় দিল এবং প্রায় সাথে সাথে একটা দা নিয়ে বের হয়ে এলো। ঝুমু খালা দা’টা হাতে নিয়ে তার ধার পরীক্ষা করে একটা সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে ঝর্ণাকে টেনে তার মায়ের কাছে নিয়ে যায়। তারপর দা’টা তার মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নেও মা।
দা’টা নেও। তারপর জোরে ঝর্ণার ঘাড়ে একটা কোপ দাও।”
মা রেগে গিয়ে বলল, “কী বলিস তুই ঝুমু!”
ঝুমু খালা শান্ত গলায় বলল, “মা, আমি কোনো ভুল কথা বলি না। কেলাস নাইনে পড়ে বাচ্চা একটা মেয়েরে দামড়া একটা মানুষের সাথে বিয়া দেওয়ার থেকে তারে এক কোপে মাইরা ফেলা ভালো। বিয়া দেওয়ার অনেক যন্ত্রণা মা। দুই দিন পর জামাই আসব যৌতুক নিতে। যৌতুক দিতে না পারলে শ্বশুর-শাশুড়ি-জামাই মিলে এমনিতেই ঝর্ণার গলা টিপে ধরবে। তার থেকে এখন এক কোপে মেরে ফেলো!”
ঝুমু খালার মা বলল, “কী বলিস তুই! জামাই ছেলে খুব ভালো, লন্ডন থাকে। এমনি এমনি কি বিয়ে দিচ্ছি নাকি?”
“না মা, তুমি বিয়া দিচ্ছ না, তুমি ঝর্ণার জীবনটা নষ্ট করতাছ। কিন্তু মা, জেনে রাখো, আমি বেঁচে থাকতে তুমি ঝর্ণারে এইভাবে বিয়া দিতে পারবা না। খোদার কসম। তুমি আমারে এখনো চিনো নাই। টি.এন.ও. সাহেব, ও.সি. সাহেব, হেড মাস্টার সাহেব সবাইরে খবর দেওয়া হইছে। পুলিশ আইসা যদি দেখে আঠারো বছরের কম বয়সে বিয়া দিতাছ, সবাইরে কোমরে দড়ি দিয়া বাইন্ধা হাজতে নিয়ে যাইব!”
হাজতের কথা শুনে হঠাৎ উপস্থিত সবার ভিতরে এবারে একটা আতঙ্কের ভাব ছড়িয়ে পড়ল। সবাই নিচু গলায় গুজগুজ করে নিজেদের ভিতর কথা বলতে থাকে। ঠিক তখন একজন বয়স্ক মানুষ হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসে। ঝুমু খালার মা ফিসফিস করে বলল, “তোর বড় চাচা আসছে, খবরদার কোনো বেয়াদপি করবি না।”
ঝুমু খালা বলল, “কী যে বলো মা, আমি মুরব্বিদের সাথে বেয়াদপি করব? সেইটা তুমি কেমন করে ভাবলা?”
ঝুমু খালা এবারে ঝর্ণার হাত ছেড়ে দিয়ে উঠানের এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা টুনিকে দেখিয়ে বলল, “ঝর্ণা, এই হচ্ছে টুনি। তারে নিয়া যা, হাত মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করে কিছু খেতে দে।”
ঝর্ণাকে একটুখানি বিভ্রান্ত দেখাল, একবার টুনির দিকে তাকাল আরেকবার ঝুমু খালার দিকে তাকাল। একটু আগে তাকে নূতন বউ হিসেবে কঠিন পাহারার মাঝে রেখেছিল, এখন হঠাৎ করে সে ছাড়া পেয়ে গেছে, কেউ কিছু বলছে না, বিষয়টা সে ভালো করে বুঝতেই পারছে না। কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ঝুমু খালার কথামতন টুনির কাছেই গেল। টুনিকে বলল, “আসো, ভিতরে আসো। একটু হাত-মুখ ধোও।”
টুনি একটু হাসির চেষ্টা করে বলল, “ঝর্ণাপু, আমি আরো একটুক্ষণ বাইরে থাকি?”
“হাত-মুখ ধোবা না? কিছু খাবা না?”
“পরে। আগে দেখি ঝুমু খালা কী করে।”
ঝুমু খালা যেটা করছিল সেটা অবশ্যি দেখার মতোই একটা দৃশ্য! তার বড় চাচা ঝুমু খালার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি কোন সময় আসছ?”
“সকালবেলা চাচাজি।”
“আইসাই একটা ঘোট পাকাচ্ছ? এই জন্যে বলছিলাম সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবার পর যেন তোমারে খবর দেয়।”
“কিন্তুক আগেই খবর পাইছি চাচাজি। মায়ের পেটের বোনের বিয়া, আমি না থাকলে কেমন হয়?”
ঝুমু খালার বড় চাচা মুখ গম্ভীর করে বলল, “ঠিক আছে। আইসা যখন পড়ছেই, থাকো। কিন্তু কোনো ঝামেলা করবা না। অনেক খানদানি ফেমিলির ছেলে–”
ঝুমু খালা তার হাতের দা’টা হাতবদল করে অদৃশ্য একটা কিছুকে কোপ দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “মনে হয় না খানদানি বংশ। তাহলে কেলাস