একটু পরেই টুনি লক্ষ করল ছোটাচ্চু গাড়ির সিটে মাথা রেখে বিচিত্র ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে গেছে। সিট বেল্ট বেঁধে রাখার কারণে মাথাটা বাঁকা হয়ে ছিল, সে কারণেই কি না কে জানে ছোটাচ্চুর নাকডাকা শোনা যাচ্ছে।
বিষয়টা ঝুমু খালাও লক্ষ করল, সে ফারিহাকে বলল, “আপা, একটু আগেই না ছোট ভাইজান কইল হে সারা রাত জাইগা থাইকা আপনার সাথে কথা বলব, এখন দেখি ছোট ভাইজান ঘুমায়।”
ফারিহাপু হাসল, বলল, “থাক ঘুমাতে দাও। মনে হয় সারা দিন ঝামেলায় গেছে।”
“কিন্তু হে যে কইল আপনারে জাগায়া রাখব!”
“সেটা তো রাখছেই। নাকডাকার শব্দটা শুনছ না? এটা দিয়েই জাগিয়ে রাখবে।”
ফারিহার কথা শুনে ঝুমু খালা আর টুনি দুজনেই হি হি করে হেসে উঠল। তাদের হাসির শব্দ শুনে ছোটাচ্চু হঠাৎ ধড়মড় খেয়ে উঠল। চমকে উঠে বলল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
ফারিহাপু বলল, “কিছু হয় নাই। তুমি ঘুমাও।”
ছোটাচ্চু বলল, “ঘুমাব কেন? না, না, আমি ঘুমাব না। আমি জেগে আছি। পুরোপুরি জেগে আছি।”
ফারিহাপু বলল, “ঠিক আছে, তুমি জেগে থাকো।”
টুনিও চেষ্টা করছিল জেগে থাকতে। কিন্তু কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল নিজেই জানে না। ঘুমের ভেতর মনে হলো কয়েকবার গাড়ি থেমেছে। গাড়ি থেকে নেমে কেউ কেউ চা খেতে গিয়েছে। আবার গাড়ি চলেছে। হঠাৎ হঠাৎ পাশে দিয়ে যাওয়া ট্রাক কিংবা বাসের বিকট হর্নের শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে, তারপর সে আবার ঘুমিয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত যখন তার ঘুম ভেঙেছে তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। টুনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল, কী সুন্দর একটা ছোট রাস্তা এঁকেবেঁকে গেছে। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ। যত দূর চোখ যায় সবুজ ধান খেত, বাতাসে ধান গাছের মাথা এমনভাবে নড়ছে যে দেখে মনে হয় বুঝি ধান খেতের উপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। দূরে হালকা কুয়াশা, দেখে মনে হয় যেন কেউ একটা ছবি এঁকে রেখেছে।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “আর কত দূর ফারিহাপু?”
“মনে হয় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।”
ঝুমু খালা বলল, “সামনে মাগরাবাজার, তারপরেই আমাগো গ্রাম।”
ফারিহাপু জিজ্ঞেস করল, “গাড়ি তোমার বাড়ি পর্যন্ত যাবে?”
“না। গাঁও-গেরামে কি আর বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি যায়?”
“তাহলে তুমি আমাকে বলল কোথায় থামতে হবে।”
“জে বলব। বাড়ি থেকে অনেক দূরে থামবেন। আমি আগে চলে যাব, তারপর আমি যখন খবর পাঠাব তখন আপনারা আসবেন। গাড়িটা কাছাকাছি রেখে হেঁটে আসতে হবে। বাড়িতে এসে ভান করবেন আপনারা আমাকে চেনেন না।”
“তোমাকে চিনি না? কেন?”
ঝুমু খালা দাঁত বের করে হাসল, বলল, “সেইটা সময়মতো আপনাদের বলব।”
টুনি বলল, “ঝুমু খালা, আমি কি তোমার সাথে আগে যেতে পারি?”
“আমার সাথে যেতে চাও? হাঁটতে হবে কিন্তু। পারবা? “পারব।”
“ঠিক আছে, তাহলে তুমি আমার সাথে যাবে।”
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আগে গিয়ে কী করবি?”
টুনি মুখ টিপে হেসে বলল, “ঝুমু খালা কেমন করে বিয়েটা ভাঙবে সেইটা দেখতে চাই।”
হঠাৎ করে ঝুমু খালার মুখ শক্ত হয়ে গেল, দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “আমি যদি খাবলা দিয়ে চোখ তুলে না ফেলি তাহলে আমি বাপের বেটি না।”
গাড়ি একটা ছোট বাজার পার হলো, বেশ ভোর, তাই দোকানপাট এখনো খোলেনি। বাজারটা পার হয়ে মিনিট দশেক যাবার পর ঝুমু খালা ফারিহাপুকে বলল, “আফা, সামনে স্কুলের সামনে আপনে থামেন। স্কুলের সামনে একটা গেস্ট হাউস আছে, আপনারা সেইখানে হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা-পানি খেতে পারবেন।”
ফারিহাপু গেস্ট হাউসের সামনে গাড়ি থামাল। দরজা খুলে সবাই নেমে পড়ল। ঝুমু খালা তার ছোট ব্যাগটা নিয়ে বলল, “আফা, ছোট ভাইজান, আমি তাড়াতাড়ি যাই। আপনারা হাত-মুখ ধুইয়া ফেরেশ হন।”
তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো টুনি। অনেক দূর হাঁটতে হবে।”
“চলো ঝুমু খালা।”
ছোটাচ্চু বলল, “গুড লাক ঝুমু। আমরা আছি।”
ঝুমু খালা স্কুলের পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। এখনো বেশ সকাল, তাই মানুষজন খুব বেশি নেই। একটা শুকনো ছেলে একটা বিশাল গরু নিয়ে যাচ্ছে। দুই পাশে ধান খেত। দূরে দূরে এক একটা গ্রাম, সেখানে গাছপালা, বাড়িঘর।
ঝুমু খালা টুনির সাথে কথা বলতে বলতে পা চালিয়ে হাঁটছে, কিন্তু যতই সে তার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতে লাগল, ততই সে চুপ হয়ে যেতে লাগল। টুনি টের পেল ঝুমু খালার ভেতরে একধরনের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। বাড়িতে গিয়ে ঠিক কী দেখবে জানে না, সেই জন্যে তার ভেতরে এই অস্থিরতা।
প্রায় আধা ঘণ্টা হাঁটার পর ঝুমু খালা একটা বড় পুকুরের কাছে দাঁড়াল, টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই যে সামনে দেখছো জোড়া তালগাছ, সেইটা আমার বাড়ি।”
টুনি বলল, “কী সুন্দর!”
ঝুমু খালা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “জায়গাটা সুন্দর, কিন্তু মানুষের মনটা সুন্দর না, তা না হলে আমার ছোট বোনটারে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে?”
ঝুমু খালা বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে, টুনি ঝুমু খালার পিছু পিছু হেঁটে যায়, বড় একটা গাছ পার হয়ে তারা একটা বাড়ির উঠোনে হাজির হলো। সেখানে বেশ কিছু মানুষ, কিছু পুরুষ, কিছু মহিলা, কিছু বাচ্চাকাচ্চাও আছে। লোকজন ব্যস্তভাবে যাওয়া-আসা করছে, কথাবার্তা বলছে, তার মাঝে ঝুমু খালা এসে ঢুকল এবং তাকে দেখে হঠাৎ করে সবাই চুপ করে গেল।