ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ মুখ সুচালো করে রেখে বলল, “দেখি তোর আম্মু আবু কী বলে। যদি পারমিশান দেয়–”
“তুমি বললেই দেবে ছোটাচ্চু। প্লিজ তুমি বলো–”
.
ঝুমু খালা যখন শুনেছে তাকে বাড়ি নেওয়ার জন্যে ছোটাচ্চুর আর গাড়ি ভাড়া করতে হচ্ছে না, ফারিহাপু নিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে তখন ঝুমু খালা আবার একটু কেঁদে ফেলল, তারপর চোখ মুছে আগের ঝুমু খালা হয়ে গেল। চিৎকার-চেঁচামেচি করে ঘরবাড়ি মাথায় তুলে ফেলল। কী হয়েছে জানার জন্যে যখন বাচ্চারা ঝুমু খালাকে ঘিরে ধরল তখন ঝুমু খালা হাত পা নেড়ে বলল, “কত বড় সাহস, আমার ছোট বইনকে, বাচ্চা মেয়েটাকে বিয়া দিতে চায়! আমি খালি একবার পৌঁছে নেই, তারপর দেখো কী করি।”
মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “কী করবে ঝুমু খালা?”
“খাবলা দিয়ে যদি চোখ দুইটা তুলে না নেই!”
“কার চোখ তুলে নেবে ঝুমু খালা?”
“যারা আমার বইনকে জোর করে বিয়ে দিতে চায়।”
মুনিয়াকে খুব বিভ্রান্ত দেখা গেল, “চোখগুলি তারপর কোথায় রাখবে ঝুমু খালা?
“বয়মের ভিতরে রেখে দিমু।”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “জামাইকে কিছু করবে না ঝুমু খালা?”
“করব না মানে! ঝাড়ুর মুড়া দিয়ে যদি দাঁত না ভাঙি!”
দৃশ্যটা কল্পনা করে বাচ্চারা সবাই কেমন জানি শিউরে শিউরে ওঠে।
.
রাত এগারোটার দিকে ফারিহাপু তার গাড়ি নিয়ে চলে এলো। ঝুমু খালা তার ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে রেডি ছিল, সে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। দাদি বললেন, “ঝুমু, মাথা গরম করে কিছু কোরো না। সবাইকে বুঝিয়ে বলো যে এত ছোট মেয়ের বিয়ে দেয়া ঠিক না।”
বড় চাচা বললেন, “এলাকার টি.এন.ও. আর থানায় খবর দিয়ে রাখবে।”
মেজ চাচি বলল, “তোমার বোন যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলের হেড মাস্টারকে জানিয়ে রেখো।”
বড় ফুপু বলল, “বেশি ঝামেলা হলে সাথে করে এখানে নিয়ে এসো, কয়েক সপ্তাহ এখানে থেকে যাবে।”
শান্ত ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঝামেলা হলে একটা মিসড কল দিবে, আমি চলে আসব। তারপর দেখি কত ধানে কত চাল।”
ঝুমু খালা বলল, “আপনারা খালি দোয়া করেন। দুই-চাইরটা মানুষের ঠ্যাং যেন ভেঙে আসতে পারি।”
সবাই নিচে নেমে গেল, ঝুমু খালাকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার জন্যে। ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে, টুনির আব্বু-আম্মুর কাছ থেকে পারমিশানও নেওয়া হয়েছে। বাসার ছোটরা কেউ জানত না তাই সবাই যখন দেখল গাড়ির পিছনে ঝুমু খালার সাথে টুনিও উঠে বসেছে তখন একসাথে সবাই হই হই করে উঠল। এখন তারাও সবাই সাথে যেতে চায়! গাড়িতে জায়গা নেই, ফেরত আসার সময় ঝুমু খালার ছোট বোন ঝর্ণাকে নিয়ে আসতে হতে পারে, সামনে পরীক্ষা, রাস্তা খারাপ, এই সব কথা বলে ছোটাচ্চু কোনোভাবে সামাল দিল।
ছোটাচ্চু ড্রাইভারের সিটের পাশে বসতেই ফারিহাপু গাড়ি স্টার্ট দিল। বাসার সামনের রাস্তাটা ধরে খানিকটা গিয়ে বড় রাস্তায় ওঠার সাথে সাথে ফাহিরাপু বলল, “শাহরিয়ার সিট বেল্ট বাঁধে।”
“সিট বেল্ট! সিট বেল্ট কেন বাঁধতে হবে?”
“আমার গাড়িতে যে-ই উঠবে তাকেই সিট বেল্ট বাঁধতে হবে।”
“যদি না বাঁধি?”
ফারিহাপু দাঁত বের করে হেসে বলল, “তাহলে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিব।”
ছোটাচ্চু বিরস মুখে সিট বেল্ট বেঁধে নিল।
রাস্তা যথেষ্ট ফাঁকা, ফারিহাপু তার মাঝে গাড়ি চালাতে থাকে। ঝুমু খালা কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ফারিহাপুর ড্রাইভিং দেখল, তারপর বলল, “আপা, আপনি বড় সুন্দর গাড়ি চালান। একেবারে এক নম্বর।”
ফারিহাপু হাসল, বলল, “ইচ্ছা করলে তুমিও গাড়ি চালানো শিখতে পারবে। তারপর তুমিও এক নম্বর ড্রাইভার হয়ে যেতে পারবে।”
“আমি পারমু?”
“পারবে না কেন? পৃথিবীর স্ট্যাটিস্টিক্স অনুযায়ী মেয়েরা ছেলেদের থেকে ভালো ড্রাইভার।”
“সত্যি?”
“সত্যি। যে কাজ ছেলেরা পারে, মেয়েরাও সেইটা পারে। বরং ভালো পারে।
ছোটাচ্চু বলল, “এইটা একটু বেশি বলে ফেললে। বলো সমান সমান পারে। ভালো পারে তার কী প্রমাণ আছে?”
“নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এই গাড়িতে আমাদের প্রমাণ দেওয়ার কোনো দরকার নাই। গাড়িতে আমরা তিনজন তেজি মেয়ে। তুমি একজন দুবলা ছেলে। আমরা যেটা বলব তোমাকে সেটা শুনতে হবে।”
ছোটাচ্চু হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। ঠিক আছে।”
ফারিহাপু ছোটাচ্চুর সাথে গল্প করতে করতে গাড়ি চালাতে লাগল। ছোটাচ্চু বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল, “ফারিহা, তোমার ড্রাইভ করতে বেশি কষ্ট হচ্ছে না তো? কষ্ট হলে আমাকে বোলো।”
ফারিহাপু বলল, “কেন? তাহলে তুমি কী করবে?”
“তাহলে তুমি গাড়ি থামিয়ে একটু রেস্ট নেবে। হাঁটাহাঁটি করবে। একটু চা-নাশতা খাবে।”
ফারিহাপু বলল, “আমার চা খাওয়ার ইচ্ছা করলে গাড়ি থামাব। হাইওয়ের পাশে চায়ের দোকান চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে।”
ছোটাচ্চু বলল, “যখন কেউ রাতে লং ড্রাইভে যায় তখন একজনকে দায়িত্ব নিতে হয়, যে ড্রাইভারের সাথে টানা কথা বলবে, যেন ড্রাইভার ঘুমিয়ে না পড়ে।”
ফারিহাপু বলল, “সেটা ভালো আইডিয়া।”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি সেই দায়িত্ব নিলাম, আমি সারা রাত জেগে থেকে তোমার সাথে কথা বলে যাব, যেন তুমি ঘুমিয়ে না পড়ো।”
ফারিহাপু বলল, “থ্যাংকু শাহরিয়ার।”
টুনি গাড়ির পিছনে বসে থেকে লক্ষ করল ছোটাচ্চু ফারিহাপুকে জাগিয়ে রাখার জন্যে তার সাথে জোরে জোরে হাত-পা নেড়ে কথা বলছে। ফারিহাপু বেশি কথা বলছে না, ছোটাচ্চুর কথার সাথে সাথে হু-হা করে যাচ্ছে।