টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ঝুমু খালা?”
ঝুমু খালা কোনো কথা না বলে হঠাৎ করে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ঝুমু খালা কাঁদছে-দৃশ্যটা এত অস্বাভাবিক যে টুনি একেবারে হতবাক হয়ে গেল। সে ঝুমু খালার পাশে বসে তার হাত ধরে বলল, “কী হয়েছে ঝুমু খালা, কোনো খারাপ খবর?”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল, বলল, “আমার ছোট বোনটারে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। কাল বিয়ে, আমি বিয়েটা ঠেকাতে পারমু না।”
টুনি বলল, “রাত্রে তো বাস থাকে
“নাই। আমার গ্রামে যাওয়ার নাইট কোচ নাই। কাল বিকালের আগে পৌঁছাতে পারুম না-ততক্ষণে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে।”
“তুমি টেলিফোন করো-টেলিফোন করে না করো।”
“টেলিফোন করে লাভ নাই। বড় চাচা ফোন ধরবে না, ধরলেও কথা শুনবে না। খালি যদি আমি নিজে হাজির থাকি তাহলে বিয়েটা ঠেকানো যেত”-বলে ঝুমু খালা আবার মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, বিড়বিড় করে বলল, “ঝর্ণারে, তোরে আমি বাঁচাতে পারলাম না।”
টুনি ঝুমু খালাকে রেখে উঠে ভিতরে গেল। ছোটাচ্চু তার ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিল, টুনি ঘরে ঢুকে বলল, “ছোটাচ্চু, ঝুমু খালা কাঁদছে।”
ছোটাচ্চু ধড়মড় করে উঠে বসল। চোখ বড় বড় করে বলল, “ঝুমু কঁদছে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন কাঁদছে?”
“ঝুমু খালার ছোট বোনকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে সেই জন্যে,। কাল বিয়ে-ঝুমু খালা গিয়ে বিয়ে থামাতে পারবে না, সেই জন্যে ঝুমু খালার খুব মন খারাপ। সেই জন্যে কাঁদছে।”
“রাতে বাস নাই?”
“না।”
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ মুখ সুচালো করে বসে রইল। তারপর উঠে দাঁড়াল। গাল চুলকাতে চুলকাতে ঘরের ভেতর একটু হাঁটল, তারপর বলল, “তুই যা, ঝুমুকে বল রেডি হতে। আমি একটা গাড়ি ভাড়া করে আনি। ঝুমুকে রাতে তার বাড়ি নিয়ে যাই।”
টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ। একটা ছোট মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে, ফাজলেমি নাকি?”
টুনি ছোটাচ্চুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি হচ্ছ সুইট থেকেও সুইট।”
ছোটাচ্চু অন্যমনস্কভাবে বলল, “শুধু একটা ছোট সমস্যা।”
“কী সমস্যা?”
“কাল বিকালে আমার আর ফারিহার শিল্পকলাতে একটা নাটক দেখতে যাওয়ার কথা ছিল, সেই প্রোগ্রামটা ক্যান্সেল করতে হবে। ফারিহা অনেক দিন থেকে এই নাটকটা দেখার জন্যে অপেক্ষা করে ছিল।”
“এটা কোনো সমস্যা না ছোটাচ্চু। ফারিহাপু অনেক সুইট, কিছু মনে করবে না। তুমি একটা ফোন করে বলে দাও।”
“হ্যাঁ, আমি ফোন করে দিই। তুই যা ঝুমুকে বল রেডি হতে।”
.
টুনি রান্নাঘরে গিয়ে দেখে ঝুমু খালা ঠিক একইভাবে বসে আছে। চোখে একটা শূন্য দৃষ্টি, তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছু দেখছে বলে মনে হচ্ছে না। টুনি ঝুমু খালার পিঠে হাত দিয়ে বলল, “ঝুমু খালা।”
ঝুমু খালা একটুখানি চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ!”
“তুমি রেডি হও। ছোটাচ্চু তোমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে।”
মনে হলো ঝুমু খালা কথাটা বুঝতে পারল না। কেমন যেন অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, “কে বাড়ি নিয়ে যাবে?”
“ছোটাচ্চু। একটা গাড়ি ভাড়া করে আনবে।”
“গাড়ি ভাড়া? আমাকে নেওয়ার জন্যে?”
“হ্যাঁ। তোমাকে নেওয়ার জন্যে।”
“ছোট ভাই গাড়ি ভাড়া করবে? আমার জন্যে?”
“হ্যাঁ। কাল সকালে পৌঁছে যাবে।”
টুনি ভেবেছিল ঝুমু খালা বুঝি খুশিতে চিৎকার দিবে কিন্তু টুনি অবাক হয়ে দেখল ঝুমু খালা আবার আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বুঝলা টুনি, আগের জন্মে আমি নিশ্চয়ই কুনো একটা ভালো কাম করছিলাম। সেই জন্যে এই জন্মে তোমাদের বাসায় থাকার সুযোগ পাইছি। এই বাসার মানুষেরা সব ফিরেশতা। কেউ ছোট ফিরেশতা, কেউ বড় ফিরেশতা। তা না হলে আমার জন্যে কেউ গাড়ি ভাড়া করে? আমি কে?”
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু মানুষটা সহজ-সরল, কিন্তু তার মনটা ভালো।”
.
ঝুমু খালাকে রেডি হতে বলে টুনি ছোটাচ্চুর কাছে গিয়ে দেখল ছোটাচ্চু তার বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে। তার মুখে বিশাল একটা হাসি। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“আমি যখন ফারিহাকে বললাম ঝুমুকে তার বাড়ি নিয়ে যেতে হবে গাড়ি ভাড়া করে, তখন ফারিহা রেগে গেল। বলল, তোমার টাকা বেশি হয়েছে? আমি বললাম, একটা ইমার্জেন্সি কেস, টাকা খরচ করতে হবে। তখন ফারিহা কি বলল জানিস?”
“কী বলল?”
“বলল, আমি ঝুমুকে গাড়ি ড্রাইভ করে তার বাড়ি নিয়ে যাব।”
“ফারিহাপু? ফারিহাপু ঝুমু খালাকে বাড়ি নিয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ। নূতন নূতন ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়েছে তো, গাড়ি চালানোর খুব উৎসাহ। সে নিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে।”
টুনি হাততালি দিয়ে বলল, “কী মজা!”
“সারারাত গাড়ি চালাতে হবে, এর মাঝে মজাটা কোথায় দেখছিস?”
টুনি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “ছোটাচ্চু তোমাকে একটা কথা বলি তুমি রাগ করবে না তো?”
“কথাটা কী, না জেনে আমি কীভাবে বলব?”
“কথাটা হচ্ছে, আমাকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাবে?” ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “তোকে?”
“হ্যাঁ। প্লিজ! ঝুমু খালা কেমন করে বিয়েটা ভাঙে সেটা দেখতে চাই!”
“সারা রাত তুই গাড়িতে বসে থাকবি?”
“হ্যাঁ। ফারিহাপু গাড়ি চালাবে, তুমি পাশে বসবে। আমি আর ঝুমু খালা বসব পিছনে।”
“কে কোনখানে বসবে সেটাও ঠিক হয়ে গেছে?” টুনি ছোটাচ্চুর হাত ধরে বলল, “প্লিজ ছোটাচ্চু, প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!”