এবারে ছোটাচ্চুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল, বিস্ফারিত চোখে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল।
টুনি বলল, “দশ টাকার নোট জাল করে তোমার পোষাবে না।”
“একশ’বার পোষাবে।” শান্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, “আমি মার্কেটিং করব টোকাইদের দিয়ে। তাদেরকে দশ টাকার জাল নোট দিয়ে বলব কিছু একটা কিনে আনতে।”
টুম্পা বলল, “কিন্তু তুমি জাল নোট বানাবে কেমন করে?”
“খুবই সোজা। রঙিন লেজার প্রিন্টারে জাল নোট ছাপাব। একটা এ ফোর কাগজে ছয়টা এঁটে যাবে।”
“তার মানে শুধু ছয়টা নম্বরের জাল নোট হবে?”
“হ্যাঁ। সমস্যা কী? কেউ কখনো নোটে কী নম্বর আছে দেখে না।”
ছোটাচ্চু তখন মুখ হাঁ করে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, শান্ত বলল, “তোরা কেউ আমাকে ধরতে পারলি না। আমি হচ্ছি ক্রিমিনালদের সেরা। এক নম্বর ক্রিমিনাল!”
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, তোমাকে ধরা খুবই সোজা।”
“কীভাবে ধরবি?”
“লেজার প্রিন্টারে খুবই সুন্দর রঙিন ছাপা হয় সত্যি-কিন্তু সেই প্রিন্টারের কার্টিজের দাম অনেক বেশি। সব জায়গাতে পাওয়া যায় না।”
“তাতে সমস্যা কী?”
“সমস্যা হচ্ছে, ঢাকা শহরে মাত্র অল্প কিছু দোকানে রঙিন লেজার প্রিন্টারের টোনার পাওয়া যায়। আমি সেই দোকানগুলোতে খোঁজ নিব, দেখব কে মাঝে মাঝেই এত দামি টোনার কিনছে। তাহলেই তুমি ধরা পড়ে যাবে।”
সবাই দেখল ছোটাচ্চু হঠাৎ কেমন জানি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠল, তারপর ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।
বাচ্চারাও তখন ছোটাচ্চুর পিছু পিছু গেল। ছোটাচ্চু নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই ফোনে একজনের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। বাচ্চারা দরজায় কান লাগিয়ে শুনল ছোটাচ্চু বলছে, “কমিশনার সাহেব, জাল নোটওয়ালাদের ধরার খুব সহজ একটা বুদ্ধি আমার মাথায় এসেছে। রঙিন লেজার প্রিন্টারের টোনার যারা বিক্রি করে তাদের দোকানে যদি চোখ রাখা যায়…”
বাচ্চারা মুখে হাত দিয়ে খিকখিক করে হাসতে হাসতে সরে এলো।
.
দুই দিন পর রাত্রিবেলা দাদির ঘরে সবাই বসে আছে তখন ছোটাচ্চ এসে ঢুকল। হাতে বিশাল একটা কেক। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “কেক! কেক!”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কেক কেন এনেছ ছোটাচ্চু!”
ছোটাচ্চু বলল, “মনে আছে পুলিশ কমিশনার কয়দিন আগে একটা কেস নিয়ে এসেছিল?”
“হ্যাঁ ছোটাচ্চু, মনে আছে।”
“সেই কেসটা সলভ করেছি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। বিশাল একটা গ্রুপকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে।”
সবাই তখন আনন্দের মতো শব্দ করল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেসটা কী ছিল ছোটাচ্চু? আমাদের বলবে?”
“না।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, “বলা যাবে না। এটা খুবই গোপনীয়।”
ঝুমু খালার গ্রামের বাড়ি
সন্ধেবেলা যখন ঝুমু খালা শিঙ্গাড়া ভেজে এনেছে তখন বড় চাচা ঝুমু খালাকে বলল, “ঝুমু, তোমার একটা চিঠি এসেছে।”
ঝুমু খালা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “বাড়িতে ঠিকানাটা দেওয়াই ঠিক হয় নাই। দুই দিন পরে পরে খালি চিঠি।”
টুম্পা বলল, “কেন ঝুমু খালা, তোমার চিঠি পেতে ভালো লাগে না?”
“সেইটা নির্ভর করে চিঠির ভিতরে কী আছে তার উপরে। বাড়ি থেকে যে চিঠি আসে সেইখানে থাকে খালি নাই নাই খবর। এইটা নাই, সেইটা নাই, এইটা লাগবে, সেইটা লাগবে-এই রকম কথাবার্তা। এই চিঠি পেলে কি ভালো লাগে? উল্টা মেজাজ গরম হয়।”
মুনিয়া বলল, “চিঠিটা খুলে দেখো-ভালো খবরও তো থাকতে পারে।”
“বাসার কাজকর্ম শেষ করি তারপর খুলব।”
ঝুমু খালা বুঝতে পারে নাই বাসার কাজকর্ম শেষ করে চিঠি খোলাটা অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে, তার সাথে সাথে চিঠিটা খোলা উচিত ছিল। চিঠিটা লিখেছে ঝুমু খালার ছোট বোন ঝর্ণা। ঝর্ণা গ্রামের স্কুলে ক্লাস নাইনে। পড়ে, সে দুই লাইনের একটা চিঠি লিখেছে :
বুবু,
বড় চাচা রবিবার চব্বিশ তারিখ আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমি বিয়ে করব না। যদি জোর করে আমাকে বিয়ে দেয় আমি গলায় দড়ি দিব, খোদার কসম।
ঝর্ণা।
চিঠি পড়ে ঝুমু খালা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। তার এই ছোট বোনটাকে সে অনেক আদর করে। অল্প বয়সে বাবা মরে যাওয়ার কারণে তার নিজের লেখাপড়া হয় নাই। সেই জন্যে ঝুমু খালা তার ছোট বোনটাকে লেখাপড়া করাতে চায়। ছোট বোন ঝর্ণা লেখাপড়ায় খুব ভালো, তাকে এইভাবে কেউ জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে ঝুমু খালা জীবনেও ভাবে নাই।
আজকে তেইশ তারিখ শনিবার, যার অর্থ বিয়ে আগামীকাল। ঝুমু খালা যদি খালি বাড়িতে গিয়ে হাজির হতে পারত তাহলেই সে বিয়ে আটকে দিত। কিন্তু এখন রাত হয়ে গেছে, শেষ নাইট কোচটা ছেড়ে দিয়েছে, যার অর্থ কাল সকালের আগে ঝুমু খালা রওনা দিতে পারবে না। বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল হয়ে যাবে। ততক্ষণে ঝর্ণাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে। কিংবা ঝর্ণা সত্যি সত্যি গলায় দড়ি দিয়ে দেবে।
ঝুমু খালা কী রকম জানি উদ্রান্তের মতো রান্নাঘরের দরজায় বসে রইল। সে এখন কী করবে?
সবার আগে টুনি ঝুমু খালাকে রান্নাঘরের দরজায় গালে হাত দিয়ে এভাবে বসে থাকতে দেখল। টুনি একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে ঝুমু খালা?”
ঝুমু খালা সবকিছু বেশি বেশি করে, যখন অল্প একটু খুশি হওয়ার কথা তখন অনেক বেশি খুশি হয়, যখন অল্প একটু রাগ হওয়ার কথা তখন অনেক বেশি রাগ হয়, যখন অল্প একটু কথা বলার কথা, তখন অনেক বেশি কথা বলে। এই প্রথমবার ঝুমু খালা কোনো কথা না বলে কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, দেখে মনে হলো ঝুমু খালা যেন। টুনির কথা বুঝতেই পারে নাই।