- বইয়ের নামঃ তবুও টুনটুনি তবুও ছোটাচ্চু
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
কবি
টুনি স্কুলের বারান্দায় বসে দেখছিল তার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা মাঠে ছোটাচ্চুটি করে খেলছে। টুনির ভেতরে একটা বড় মানুষ বড় মানুষ ভাব আছে, তাই সে সবসময় সবার সাথে ছোটাচ্চুটি করতে পারে না। অনেক সময়েই সে বারান্দায় বসে বসে অন্যদের ছোটাচ্চুটি করতে দেখে। টুনি দেখল, খেলার মাঠে কিছু একটা হয়েছে আর তখন একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে পারলে একজন বুঝি আরেকজনকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। ঠিক কী নিয়ে দুইজন ঝগড়া করছে টুনি সেটা বোঝার চেষ্টা করছিল, ঠিক তখন শুনল রিনরিনে গলার স্বরে কে যেন ডাকল, “টুনি আপু।”
টুনি তাকিয়ে দেখে তাদের স্কুলের ছোট ক্লাসের একটা মেয়ে তাকে ডাকছে। টুনি তার দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “কী আপু?”
মেয়েটি ছোট হলেও বড়দের মতো করে বলল, “আমি কি তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”
টুনি বলল, “একশ’বার। এসো, আমার পাশে বসো।”
মেয়েটা টুনির পাশে বসে টুনির দিকে তাকাল। টুনি দেখল মেয়েটার চোখে পানি টলটল করছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তোমার?”
মেয়েটা হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল, “আমার খুব মন খারাপ।”
“কেন? তোমার কেন মন খারাপ?”
“দৈনিক নতুন পৃথিবী পত্রিকা আমাকে অপমান করেছে।”
টুনি চোখ বড় বড় করে মেয়েটার দিকে তাকাল। দৈনিক নতুন পৃথিবী এই দেশের অনেক বড় পত্রিকা। সেই পত্রিকা মন্ত্রী-মিনিস্টারদের পর্যন্ত জীবন বরবাদ করে দেয়, সেই পত্রিকা এইটুকুন একটা বাচ্চা মেয়েকে কেমন করে অপমান করতে পারে টুনি বুঝে পেল না। মেয়েটার কথা শুনে টুনির একটু হাসি পেয়ে যায় কিন্তু সে হাসিটা গোপন করে জিজ্ঞেস করল, “নতুন পৃথিবী তোমাকে কেমন করে অপমান করল?”
“এই দেখো।” বলে মেয়েটা তার স্কার্টের পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে তাকে দিল।”
টুনি কাগজটা খুলে দেখে সত্যি সত্যি এটা নতুন পৃথিবী পত্রিকার প্যাডের কাগজ। সেখানে টাইপ করে লেখা :
প্রিয় মেহজাবিন আরা মিলা
নতুন পৃথিবী ও ম্যান্ডারিন ক্রোকারিজের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত শিশু-কিশোর সাহিত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।
তবে তুমি নিজের লেখা কবিতা জমা না দিয়ে অন্য কারো লেখা একটি কবিতা নিজের নামে জমা দিয়েছ দেখে আমরা অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি। যদি এই কোমল বয়সে তুমি এই ধরনের অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে যাও তাহলে তুমি বড় হয়ে এই দেশ সমাজের কোনো কাজে আসবে না।
কাজেই আমরা আশা করব তুমি ভবিষ্যতে এই ধরনের অন্যায় কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকবে।
তোমার শুভাকাক্ষী
কাতিমুন নাহার
নির্বাহী সম্পাদক
শিশু-কিশোর সাহিত্য প্রতিযোগিতা
টুনি চিঠিটা পড়ে ছোট মেয়েটার দিকে তাকাল, “এই চিঠিটা তোমাকে লিখেছে? তোমার নাম মেহজাবিন আরা মিলা।”
মিলা নামের মেয়েটা মাথা নাড়ল।
“তুমি এদের প্রতিযোগিতায় একটা কবিতা পাঠিয়েছিলে? নিজের লেখা কবিতা?”
“মেয়েটা আবার মাথা নাড়ল।”
“নতুন পৃথিবী মনে করেছে তুমি এটা অন্যের লেখা থেকে চুরি করেছ?”
মিলা ঠোঁট উল্টে প্রায় কেঁদেই দিচ্ছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে মাথা নাড়ল।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন তারা আরো ভেবেছে তুমি আরেকজনের কবিতা চুরি করেছ?”
মিলা বলল, “জানি না।”
“তোমার কবিতাটা কি আছে? মিলা মাথা নাড়ল, “আছে।”
“দেখি।”
মিলা তখন তার স্কার্টের পকেট থেকে আরেকটা কাগজ বের করে টুনির হাতে দিল। টুনি কাগজটা খুলে দেখে সেখানে একেবারে মুক্তার মতো ঝকঝকে হাতের লেখায় একটা কবিতা লেখা। টুনি জিজ্ঞেস করল, “এটা কার হাতের লেখা?”
“আমার।” টুনি অবাক হয়ে বলল, “তোমার?”
“হ্যাঁ।”
টুনি অবাক হয়ে বলল, “তুমি এইটুকুন একটা মেয়ে, আর তোমার হাতের লেখা এত সুন্দর?”
মিলা কিছু না বলে চুপ করে রইল। টুনি তখন কবিতাটি পড়ল :
দূর্বাঘাস ভোরের সূর্যকে ডেকে বলে
দেখো, সারা রাত অনেক ভালোবাসায় জড়ো করেছি
এক ফোঁটা শিশির।
সূর্য হা হা করে হাসে, তারপর প্রখর রোদ্দুর দিয়ে
শুষে নেয় শিশিরের কণা।
সন্ধেবেলা সূর্যের আলো যখন ক্ষীণ ম্রিয়মাণ
দূর্বাঘাস বলে, সন্ধ্যার অন্ধকারে যদি হারিয়েই যাবে
তাহলে কেন জ্বলে উঠো দুপুরবেলায়?
টুনি হাঁ করে মিলার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঢোক গিলে বলল, “এটা তুমি লিখেছ?”
মিলা মাথা নাড়ল। টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি, মানে তুমি লিখেছ?”
মিলা আবার মাথা নাড়ল।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?”
“ক্লাস ওয়ান।”
“তুমি ক্লাস ওয়ানে পড়ো আর সূর্যের আলো ক্ষীণ ম্রিয়মাণের কবিতা লেখো?”
এটা টুনির অভিযোগ না প্রশংসা বুঝতে না পেরে মিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন, কী হয়েছে?”
“ক্লাস ওয়ানের ছেলেমেয়েরা স্বরে আ ম আম কিংবা ক লয়ে আকার লা কলা পড়তে গিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলে আর তুমি শিশির কণার উপর কবিতা লিখো?”
মিলা একটু দুশ্চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “লিখলে কী হয়?”
“লিখলে কিছু হয় না। কিন্তু ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা কখনো এ রকম কবিতা লিখে না। লিখার কথা না।” টুনি হঠাৎ করে ঘুরে মিলার দিকে তাকাল, তারপর চোখ সরু করে বলল, “তুই সত্যি সত্যি বল দেখি যে তুই নিজে এটা লিখেছিস?”