ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, আমি মোটেও টুনিকে নিচ্ছি না।
তাহলে সবাই যে বলছে—
ছোটাচ্চু হিংস্র গলায় বলল, কে বলছে?
ওই তো রনি, পিকু, টুশি, শায়লা—
রনি, পিকু, টুশি, শায়লা–এরা এই বাসার মানুষজন। এদের নামও মনে রাখা সম্ভব না। দরকারও নেই।
ছোটাচ্চু মুখ আরও শক্ত করে বলল, সবাই মিলে পেয়েছে কী? আমি সবগুলোকে খুন করে ফেলব।
ভাবি হেসে বলল, তুমি ডিটেকটিভ মানুষ, নিজেই যদি খুন করে ফেলো, তাহলে কেমন করে হবে? অন্যরা খুন করবে, তুমি সেটা বের করবে। বইয়ে তো সে রকমই লেখে। কথা শেষ করে ভাবি টেনে টেনে আরও কিছুক্ষণ হাসল।
ছোটাচ্চু বলল, ভাবি তুমি এভাবে হাসবে না। এটা মোটেও ঠাট্টার বিষয় না।
কিছুক্ষণের মাঝে অনেকগুলো বাচ্চা ছোটাচ্চুকে ঘিরে ফেলল, তারা সবাই এক সাথে কথা বলতে লাগল। কথাগুলো ছিল এ রকম—যদিও সবাই এক সাথে কথা বলার কারণে কেউ কিছু শুনতে পারছিল না, বুঝতেও পারছিল না।
একজন বলল, তুমি বলেছিলে এটা ছোটদের জন্য না, তাহলে টুনিকে কেন নিলে? আমাকে কেন নিলে না?
আরেকজন বলল, টুনি কি ছোট না? টুনি আমার থেকে ছোট।
অন্যরা বলল।
টুনি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট? কেন? কেন? কেন?
তোমার সাথে আমরা কোনোদিন খেলব না। তুমি টুনিকে নিলে আর আমরা এত করে বললাম আমাদের নিলে না।
অন্যায়। অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়।
মানি না। মানি না।
ধ্বংস হোক। ধ্বংস হোক।
জ্বালো জ্বালো। আগুন জ্বালো।
ছোটাচ্চু যদিও কারও কথাই স্পষ্ট করে শুনতে পারছিল না, তবু বুঝে গেল সবাই কী নিয়ে কথা বলছে। সে চিৎকার করে বলল, চোপ। সবাই চোপ। এক্কেবারে চোপ।
একজন মিনমিন করে বলল, চোপ বলে কোনো শব্দ নাই। শব্দটা হচ্ছে চুপ।
আরেকজন বলল, চুপ থেকে পাওয়ারফুল হচ্ছে চোপ। তাই না। ছোটাচ্চু?
ছোটাচ্চু তাদের কারও কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আমি তোদের সবাইকে খুব স্পষ্ট করে একটা কথা বলতে চাই। আমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি মোটেও পোলাপানের খেলা না। এটা বড় মানুষদের দিয়ে তৈরি বড় মানুষের সমস্যা সমাধানের একটা সিরিয়াস এজেন্সি। এখানে কোনো বাচ্চাকে নেওয়া হয় নাই। টুনিকেও নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
একজন বলল, তাহলে টুনি যে বলল সে তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট?
সে মোটেও আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট না। ডাক টুনিকে।
টুনিকে ডাকতে হলো না, ঠিক তখন দেখা গেল টুনি তার স্টিলের তৈরি গোল গোল চশমা চোখে হেঁটে হেঁটে আসছে। মুখে একেবারে ঘন মেঘ কিংবা কংক্রিটের দেয়ালের মতো গাম্ভীর্য। ছোটাচ্চু হুংকার দিল, টু-নি।
টুনি দাঁড়িয়ে গিয়ে চশমার ফাক দিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, কোনো কথা বলল না, বলা প্রয়োজন মনে করল না। ছোটাচ্চু আরও জোরে হুংকার দিয়ে বলল, তুই নাকি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিস যে তুই আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট?
টুনি না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু তখন তার গলা আরও এক ধাপ ওপরে তুলে বলল, সবাই বলছে তুই এটা বলেছিস—
টুনি প্রথমবার মুখ খুলল, বলল, আমি সবাইকে বলেছি, তুমি তোমার বুদ্ধি দিয়ে কখনো তোমার ডিটেকটিভ এজেন্সি চালাতে পারবে না। এটা চালাতে হলে আমাকে তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বানাতে হবে।
ছোটাচ্চু চিৎকার করে বলল, কী বললি? কী বললি তুই?
টুনি কোনো উত্তর না দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। ছোটাচ্চু আরও জোরে চিৎকার করে বলল, দেখলি, টুনির সাহসটা দেখলি তোরা? সে নিজেকে ভেবেছে কী? মাদাম কুরি নাকি হাইপেশিয়া?
বাচ্চাকাচ্চারা মাদাম কুরিকে চেনে না, হাইপেশিয়া কি মানুষ না একটা রোগের নাম, সেটাও ধরতে পারল না। শুধু অনুমান করল ছোটাচ্চু খুব রেগেছে। তবে ছোটাচ্চুর রাগ নিয়ে বাচ্চাকাচ্চারা বেশি মাথা ঘামায় না। তাই তারা এবারও এটা নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করল না।
তবে মজার ব্যাপার হলো, এক সপ্তাহের মাঝে সবাই আবিষ্কার করল টুনির কথা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি!
০৩. জোবেদা খানম
জোবেদা খানম তাঁর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে যে তিনতলা কিংবা চারতলা (যেটা আসলে সাড়ে তিনতলাও হতে পারে) বাসায় থাকেন, তার কাছাকাছি একটা একতলা বাসা আছে। একতলা বাসা বলে কেউ যেন সেটাকে তাচ্ছিল্য না করে, তার কারণ সেই বাসা দেখলে যে কেউ ট্যারা হয়ে যাবে। তবে বাসাটা উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা বলে কেউ বাসাটা দেখতে পায় না, তাই কেউ এখনো ট্যারা হয়ে যায়নি। বাসাটা অনেক জায়গাজুড়ে, মনে হয় তিন-চারটা ফুটবল মাঠের সমান। বাসার সামনে-পেছনেও অনেক জায়গা, সেটাও মনে হয় পাঁচ-ছয়টা ফুটবল মাঠের সমান। বাসার ভেতরে নানা রকম গাছ। বাসার কাছাকাছি যাবার জন্যে কংক্রিটের রাস্তা, যেকোনো সময় সেখানে তিন-চারটা দামি দামি গাড়ি থাকে। বাসার সামনে ফুলের বাগানে সারা বছর নানা রকম ফুল ফুটে থাকে, কিন্তু সেগুলো কেউ দেখতে পায় না। তার কারণ কেউ বাসার ভেতরে ঢুকতে পারে না। বাসার সামনে যে বিশাল গেট সেখানে পাহাড়ের মতো একজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে। গেট দিয়ে কেউ ভেতরে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলেই সেই দারোয়ান হুংকার দিয়ে বলে, খ-ব-র-দা-র?
সেই বাসার মালিকের নাম হাজি গুলজার খান। স্থানীয় লোকজন বলে গুলজার খান একসময় অনেক বড় গুণ্ডা ছিল, চুরি-ডাকাতি-খুন করে বিশাল সম্পত্তি তৈরি করেছে, তারপর হজ্ব করে এসে সে এখন ভালো মানুষ হয়ে গেছে। তার স্ত্রী কতজন, ছেলেমেয়ে কতজন, তারা কে কী করে, কে কোথায় থাকে সেগুলো কেউ ভালো করে জানে না, তবে সবাই একদিন খবর পেল হাজি গুলজার খানের মেয়ের বিয়ে। সেই বিয়ের আয়োজন দেখে সবার তাক লেগে গেল। বিয়ে উপলক্ষে কত কী যে হলো তার কোনো হিসাব নাই। আর এই বিয়ের কারণে এই এলাকার মানুষজন প্রথমবার হাজি গুলজার খানের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারল। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে তার বাসায় একেক দিন একেক আয়োজন, শুধু তাই না, প্রথমবার এলাকার মানুষজনের জন্যে গেট খুলে দেয়া হয়েছে। রাতের বেলা কোনোদিন কনসার্ট, কোনোদিন সার্কাস, কোনোদিন যাত্রাগান আর সারাদিন ধরে মেলা। এলাকার লোকজন সুযোগ পেয়ে সবাই ভিড় করে সেগুলো দেখতে গেল। জোবেদা খানমের নাতি-নাতনিরাও তখন প্রথমবার হাজি গুলজার খানের বাড়ির ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেল। তারা তাদের বাসার চার দেয়ালের মাঝখানে যা খুশি করতে পারে, কিন্তু বাসার বাইরে গেলে তাদের কঠিন নিয়ম মানতে হয়। সন্ধ্যাবেলার মাঝে তাদের সবার বাসায় ফিরে আসতে হয়। মাগরিবের আজানের পর কেউ বাইরে থাকতে পারে না। তাই হাজি গুলজার খানের বাড়িতে তারা শুধু মেলাটাই দেখতে পেল, রাত্রের আয়োজন কনসার্ট, সার্কাস, থিয়েটার বা যাত্রা দেখার সুযোগ পেল না।