টুনির কথা কেউ শুনল না, সবাই অবাক হয়ে গাবড়া বাবার দিকে তাকিয়ে রইল, এখন তাকে দেখাচ্ছে খুবই অদ্ভুত। মাথায় একটাও চুল নাই বিস্তৃত টাক, মুখে একটা দাড়িও নেই। থুতনিটা ছোট, মনে হয় তাকে তৈরি করার সময় মালমশলার অভাব হয়েছিল বলে থুতনিটা অসমাপ্ত রেখে শেষ করে দেয়া হয়েছে। পাতলা ঠোঁট আর তরমুজের বিচির মতো কালো কালো দাঁত বের হয়ে আছে। কুকুতে চোখ এবং দেখে মনে হয় কেউ একজন একটা খাটাসকে সিদ্ধ করে তার সবগুলো লোম খিমচে খিমচে তুলে নিয়েছে। মানুষটার দিকে তাকালে সবার আগে যেটা চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে ডান গালে একটা কাটা দাগ, কানের নিচ থেকে শুরু করে থুতনি পর্যন্ত লোম এসেছে।
গাবড়া বাবা নামের মানুষটার কয়েক সেকেন্ড লাগল বুঝতে কী হচ্ছে, তারপর হাত দিয়ে তার লাল রঙের ঝোলাটা হাতে নিয়ে সে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে সে একটা রিভলবার বের করে সবার দিকে তাক করে বলল, খবরদার। খুন করে ফেলব।
যে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ অনুমান করেনি হঠাৎ করে ঘটনাটা এভাবে মোড় নেবে। লোমবিহীন খাটাসের মতো দেখতে গাবড়া বাবা নামের মানুষটা তার রিভলবারটা সবার দিকে তাক করে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। লাথি দিয়ে দরজাটা খুলে হিংস্র গলায় বলল, খবরদার! আমার পিছনে পিছনে আসলে খুন করে ফেলব।
তনুর মা বললেন, কেউ তোমার পিছন পিছন যাবে না। তুমি বিদায় হও। তারপর মানুষটা শুনতে পায় না সেভাবে ফিস ফিস করে বললেন, বদমাইস জোয়াচ্ছ্বর কোথাকার!
গাবড়া বাবা নামের মানুষটা দড়াম করে দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। তারা শুনতে পেল সে বসার ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে যাচ্ছে।
ছোটাচ্চুর হাতে গাবড়া বাবার চুল, টুনির হাতে তার দাড়ি। ছোটাচ্চু চুলগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে টুনিকে জিজ্ঞেস করল, তুই কেমন করে জানলি এর চুল দাড়ি নকল।
আমার বিজ্ঞানের বই।
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, বিজ্ঞানের বই?
হ্যাঁ, মনে নেই, আমার বিজ্ঞানের বইটা এই ঘরে ভুল করে রেখে গিয়েছিলাম?
হ্যাঁ। তাতে কী হয়েছে?
আসলে ভুল করে ফেলে যাই নাই, ইচ্ছা করে ফেলে গিয়েছিলাম। তার কারণ হচ্ছে আসলে ঐ বইটা খালি বিজ্ঞানের বই ছিল না, তোমার ভিডিও ক্যামেরাটা এর মাঝে ফিট করা ছিল।
ছোটাচ্চুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল, আমার ভিডিও ক্যামেরা?
টুনি বলল, হ্যাঁ। সারারাত এই ঘরের ভিডিও তুলেছে। সেই ভিডিওতে আমি দেখেছি গাবড়া বাবা রাত্রিবেলা চুল দাড়ি খুলে ঘ্যাস ঘ্যাস করে মাথার চাদি আর গাল চুলকায়।
আমাকে বলিসনি কেন?
ভয়ে।
কীসের ভয়?
তুমি যদি বকা দাও। মনে নাই আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম আর কোনোদিন তোমাকে জ্বালাব না!
তাই বলে এটা বলবি না? এখন দেখ লোকটা পালিয়ে গেল, আগে থেকে জানলে ধরে ফেলতে পারতাম।
টুনি মুখ কাচুমাচু করে বলল, একটা কথা বলব ছোটাচ্চু?
কী কথা?
তুমি বকা দিবে না তো?
না বকা দিব না। বল।
এই লোকটা আসলে পালিয়ে যেতে পারবে না।
ছোটাচ্চু চোখ বড় বড় করে বলল, পালিয়ে যেতে পারবে না? কেন?
তোমার পারমিশান না নিয়েই তোমার নামে শান্ত ভাইয়ার সাথে পাঁচশ টাকার কন্ট্রাক্ট করেছি।
কী কন্ট্রাক্ট করেছিস?
শান্ত ভাইয়া তার বন্ধুদের নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছে। তাকে বলেছি যদি দেখে কালো আলখাল্লা পরা কোনো মানুষ ছুটে বের হয়ে যায় তাকে ধরে ফেলতে হবে। মানুষটার হয় অনেক লম্বা লম্বা চুল দাড়ি থাকবে, না হলে একেবারে চাঁচাছোলা হবে।
সত্যি?
হ্যাঁ, লোকটা পালাতে পারবে না। ছোটাচ্চু দুশ্চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু মানুষটার কাছে রিভলবার—
টুনি মাথা নাড়ল, কোনো সমস্যা নাই। শান্ত ভাইয়ার বন্ধুদের মাঝে দুইজন ব্ল্যাকবেল্ট। রিভলবার চাকু ওদের কাছে কোনো ব্যাপার না।
ছোটাচ্চুর দুশ্চিন্তা তবু যায় না, বলল, তারপরও —
আসলে ছোটাচ্চুর দুশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। গাবড়া বাবা যখন গেট খুলে বের হল, শান্ত আর তার বন্ধুদের বুঝতে একটুও দেরি হল না যে এই সেই লোক। কালো আলখাল্লা, লাল ব্যাগ, মাথায় একটা চুল নেই, মুখে। একটা দাড়ি নেই, কেমন যেন চাঁচাছোলা ভাব। মানুষটার দিকবিদিক জ্ঞান নেই, গেট খুলে প্রাণ নিয়ে ছুটতে থাকে। তাকে ধরার কোনো চেষ্টা না করে শান্ত তাকে ল্যাং মেরে দিল, আর মানুষটা তখন তাল হারিয়ে একেবারে কাটা কলাগাছের মতো আছাড় খেয়ে পড়ল। সেই অবস্থায় লোকটা তার লাল ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে তার রিভলবারটা বের করার চেষ্টা করছিল, তখন ব্ল্যাকবেল্ট নম্বর ওয়ান একটা লাথি দিয়ে তার হাতের বারোটা বাজিয়ে দিল। ঠিক তখন দুই নম্বর ব্ল্যাকবেল্ট পিছন থেকে তার হাতটা এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরল যে তার আর নড়ার উপায় থাকল না। অন্যরা তখন ছুটে এসে তার শরীরের নানা জায়গা মাটির সাথে চেপে ধরে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। শান্তর গলা উঠল সবার উপরে, আর দেখতে দেখতে গাবড়া বাবাকে ঘিরে মানুষের ভিড় জমে গেল। একজন কাছে এসে গাবড়া বাবাকে এক নজর দেখে চিৎকার করে উঠল, আরে! এটা তো গাল কাটা বকইর্যা!
আরেকজন জিজ্ঞেস করলাম, সেটা আবার কে?
শীর্ষ সন্ত্রাসী। দেওয়ালে বিশজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর পোস্টার দিয়েছে দেখেন নি? ধরতে পারলেই পুরস্কার। এ হচ্ছে তাদের একজন।