গাবড়া বাবা তখন একটা ঝাকুনি দিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, কে? কী?
কেউ কোনো কথা বলল না। গাবড়া বাবা বলল, এসেছিল? তোমার স্বামী এসেছিল? ভর করেছিল আমার উপর?
এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না। গাবড়া বাবা বলল, কী হল? তোমরা সবাই চুপ করে আছ কেন?
এবারে ছোটাচ্চু বলল, তার কারণ আমরা বুঝতে পেরেছি আপনি একজন ভণ্ড।
এবারে গাবড়া বাবা চমকে উঠল, বলল, ভণ্ড?
হ্যাঁ, আপনি ভণ্ড এবং প্রতারক।
গাবড়া বাবা আরো জোরে চমকে উঠল, ভণ্ড এবং প্রতারক?
হ্যাঁ।
কেন এরকম বলছ? কী হয়েছে তোমার?
তার কারণ তনুর বাবা আনোয়ার হোসেনের আগের কোনো স্ত্রী নেই। আগের কোনো ছেলে নেই। আনোয়ার হোসেনের একজনই স্ত্রী আর একজনই মেয়ে।
গাবড়া বাবা কেমন যেন ঘাবড়ে গেল, বলল, কিন্তু কিন্তু কিন্তু–
এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। আমরা আগেই সন্দেহ করছিলাম আপনি ভণ্ড। আপনি ভান করেন যে, আপনার উপর আত্মা ভর করে, আপনার মুখ দিয়ে আত্ম কথা বলে। আসলে সব আপনার একটিং!
এবারে তনুও মুখ খুলল। গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল, আমার বাবা কখনো আগে আরেকটা বিয়ে করেনি!
গাবড়া বাবা এবারে কেমন যেন ঘাবড়ে গেল, আমতা আমতা করে বলল, না মানে ইয়ে, আসলে এটা তো আমি বলি নাই, আনোয়ার সাহেবের আত্মা বলেছে।
তনু আরো জোরে চিৎকার করে বলল, মোটেও আমার বাবার আত্মা এসে এগুলো বলেনি! আমার বাবার আত্মা এসে ফালতু মিথ্যা কথা বলে বেড়াবে না।
গাবড়া বাবা এবারে মোটামুটি ভয় পেয়ে গেল, মনে হল সে তার ঝোলাটার দিকে হাত বাড়াল, হাতে নিয়ে মনে হয় একটা দৌড় দেবে কিন্তু ঠিক সেই সময় তনুর মা তীক্ষ গলায় চিৎকার করে বললেন, তনু! তুই থামবি?
তনু প্রায় কান্না কান্না গলায় বলল, কেন মা? আমাকে কেন থামতে হবে? এই লোক আমাদের ঠকিয়ে যাচ্ছে, আমাদের সাথে তামাশা করছে আর দিনের পর দিন আমাদের সেটা সহ্য করতে হবে?
তনুর মা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, গাবড়া বাবা মোটেও তামাশা করছেন।
তনু হকচকিয়ে গিয়ে বলল, মানে?
গাবড়া বাবার একটা কথা এখনো ভুল বের হয়নি। নিশ্চয়ই তোর বাবা গোপনে আরেকটা বিয়ে করেছিল। আমাকে কখনো বলে নাই। পরকালে সেটা নিয়ে অপরাধবোধে ভুগছে। এখন নিশ্চয়ই সেটা আমাদেরকে জানাতে চায়। আমাদেরকে বলে অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হতে চায়। আমাদের এখন খোঁজ নিতে হবে। ছেলেটাকে খুঁজে বার করতে হবে।
তনু চোখ কপালে তুলে বলল, কী বলছ তুমি মা? তুমি জান তোমার গাবড়া বাবা কেন এই কথা বলছে? তুমি জান?
তনুর মা বলল, আমার কোনো কিছু জানার দরকার নাই। শুধু তুই জেনে রাখ, আমার মেয়ে হয়ে তুই গাবড়া বাবাকে অসম্মান করতে পারবি না। তোকে এক্ষুনি গাবড়া বাবার পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।
তনুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে গাবড়া বাবার মুখের দিকে তাকাল, তার চোখেমুখে তখন আনন্দের মৃদু হাসি, শুধুমাত্র বড় বড় দাড়ি-গোঁফের কারণে সেটা ঢাকা পড়ে আছে। তনুর মা আবার বললেন, পা ধর গাবড়া বাবার। এক্ষুনি পা ধর বলছি।
তনু পা ধরল না, তার চেহারাটা কেমন জানি ম্লান হয়ে গেল। তনুর মা চিৎকার করে বলল, পা ধরে মাপ চা বলছি। তা না হলে তোকে আমি ত্যাজ্য কন্যা করে দেব। বাড়ি থেকে বের করে দেব–
ঠিক তখন দরজায় বেল বাজল, কেউ একজন এসেছে। গাবড়া বাবা এই বাসায় জায়গা নেবার পর অন্য কেউ আজকাল খুব আসে না। বেল বাজার জন্যে অবশ্যি তনু উঠে যাবার সুযোগ পেল। দরজা খুলে দেখে সেখানে টুনি দাঁড়িয়ে আছে। তনু অবাক হয়ে বলল, তুমি? তুমি কোথা থেকে?
টুনি বলল, এই তো এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হল একবার আপনাদের দেখে আসি।
তনু কিছু বলল না। টুনি বলল, আপনাদের কী খবর?
তনু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, খবর ভালো না।
ভেতর থেকে তনুর মা বললেন, তনু। ভেতরে আয় বলছি। গাবড়া বাবার সাথে বেয়াদপী করার জন্যে এক্ষুনি পা ধরে মাপ চা।
টুনি কী একটা ভাবল, তারপর দরজা ঠেলে গাবড়া বাবার ঘরে ঢুকে গেল। ভেতরে আবছা অন্ধকার, ছোটাচ্চু তার মাঝেই টুনিকে দেখে অবাক হয়ে বলল, টুনি! তুই কী করছিস এখানে?
টুনি বলল, মনে নাই, আমার নাচের ক্লাস হয় এখানে। ছোটাচ্চু রেগে বলার চেষ্টা করল, না-না-নাচ?
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমার নাচের টিচারকে গাবড়া বাবার কথা বলেছি, তাই নাচের টিচার একটা জিনিস নেবার জন্যে আসতে চাচ্ছিলেন। আমি বললাম, আমিই নিয়ে আসব।
ছোটাচ্চু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, কী জিনিস?
গাবড়া বাবার একটা চুল।
চুল? চুল দিয়ে কী হবে?
তাবিজ। টুনি চোখ বড় করে হাত নেড়ে বলল, আমার নাচের টিচার বলেছেন, সিদ্ধ পুরুষের চুল দিয়ে তাবিজ বানানো যায়। ফাটাফাটি তাবিজ!
তনুর মা জিজ্ঞেস করলেন, কিসের তাবিজ?
সবকিছুর তাবিজ। আমাদের নাচের টিচার তার ছেলের জন্যে বানাতে চাইছে।
ছেলের কী সমস্যা?
বিছানায় পিশাব করে দেয়।
তনুর মা একটু থতমত খেয়ে বললেন, ও!
টুনি সবাইকে পাশ কাটিয়ে গাবড়া বাবার দিকে এগিয়ে যায়। গাবড়া বাবা কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে বলল, দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি। আমার একটা চুল ছিড়ে দিচ্ছি।
টুনি বলল, আপনাকে দিতে হবে না। আপনি বসে থাকেন, আমি নিয়ে নেব। একটা চুল, খালি একটা।
গাবড়া বাবা দুই হাতে নিজের চুল জাপটে ধরে বলল, না, না।
কিন্তু ততক্ষণে টুনি প্রায় ডাইভ দিয়ে গাবড়া বাবার চুল ধরে ফেলেছে। সে বলেছে তার একটা চুল দরকার কিন্তু দেখা গেল সে মোটেও একটা চুলের জন্যে চেষ্টা করছে না। খাবলা দিয়ে চুলের ঝুটি ধরে ফেলেছে। এতোগুলো চুল ছেড়া সম্ভব না কিন্তু তারপরও টুনি হ্যাচকা টান দিয়ে চুলের গোছা ছিড়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। সবাই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে এবং তার মাঝে হঠাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটি ঘটে গেল। টুনির হ্যাচকা টানে হঠাৎ করে গাবড়া বাবার মাথার পুরো চুল উপড়ে টুনির হাতে চলে এলো। অন্য সবাই বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেও টুনি মোটেই অবাক হল বলে মনে হল না। সে পুরো চুলগুলো ছোটাচ্চুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে এবারে খাবলা দিয়ে গাবড়া বাবার দাড়ি ধরে হ্যাচকা টানের পর টান দিতে লাগল। কোনো একটা বিচিত্র কারণে এবারে সবাই বুঝে গেল চুলের মতো পুরো দাড়িগুলোও উপড়ে চলে আসবে। বড় ধরনের হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল, গাবড়া বাবা ঝটকা দিয়ে টুনিকে সরানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু টুনি গাবড়া বাবার দাড়ি ছাড়ল না, সে টানতেই লাগল এবং হঠাৎ করে পুরো মিশমিশে কালো দাড়ি গাবড়া বাবার মুখ থেকে খুলে এলো। টুনি সেই দাড়িগুলো বিজয়ীর মতো ধরে রেখে বলল, তাবিজ বানানোর জন্য আসল চুল দাড়ি দরকার। এই নকল চুল দাড়ি দিয়ে হবে না।