টুনি ছোটাচ্চুকে এমনভাবে জ্বালাতন করল যে ছোটাচ্চু সেদিন তনুদের বাসা থেকে তার বিজ্ঞানের বইটা উদ্ধার করে নিয়ে এল। কৃতজ্ঞতা হিসেবে
টুনি ছোটাচ্চুর গালে একটা চুমু দিতে রাজি ছিল কিন্তু ছোটাচ্চু সেটা নিতে রাজি হল না। তবে তনুর বাসায় কী হয়েছে সেটা বেশ রংচং দিয়ে টুনিকে শুনিয়ে দিল। এখন শুধু অপেক্ষা করতে হবে কখন গাবড়া বাবার উপর তনুর বাবার আত্মা এসে ভর করে। সেটার জন্যে খুব বেশি দেরি হওয়ার কথা না।
সত্যি সত্যি একদিন পরেই ছোটাচ্চুকে তনু খবর দিল, গাবড়া বাবা জানিয়েছে তনুর বাবা তার পরিবারকে কিছু জরুরি খবর দিতে চায়। রাত্রিবেলা তনুর বাবা স্বপ্নে বলে গেছে। গাবড়া বাবা সেজন্যে বিকেলে মৃত আত্মাকে আহ্বান করতে চায়।
শুনে তনু খুবই কাচুমাচু হয়ে বলল, ছোটাচ্চু–
ছোটাচ্চু কথাটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করল না, রীতিমতো হুংকার দিয়ে বলল, নো। নেভার। তোকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
একবার। শুধু একবার। এই শেষ-
ছোটাচ্চু আরো জোরে হুংকার দিল, না। এর আগেরবার তুই বলেছিস আর কোনোদিন আমাকে জ্বালাতন করবি না।
আমি জ্বালাতন করব না ছোটাচ্চু। চুপ করে থাকব। এর আগেরবার কি একবারও কথা বলেছিলাম?
ছোটাচ্চু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, না। এটা বড়দের ব্যাপার। ভণ্ড কাপালিককে হাতে নাতে ধরা হবে। এখানে শুধু বড়রা থাকবে। ছোটদের জায়গা এটা না।
টুনি তারপরেও চেষ্টা করল কিন্তু ছোটাচ্চু কিছুতেই রাজি হল না।
দুপুরের দিকে কিছু একটা খেয়ে ছোটাচ্চু বের হয়ে গেল। টুনি তখন শান্তকে খুঁজে বের করে বলল, শান্ত ভাইয়া, তোমার সাথে কথা আছে।
কী কথা?
আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।
কতো টাকার কাজ?
এখনো জানি না, কম হলেও পাঁচশ টাকা তো হবেই।
শান্তর চোয়াল ঝুলে পড়ল, বলল, পাঁ-চ-শ-টা-কা?
টুনি বলল, বেশিও হতে পারে, সেটা নির্ভর করবে তোমার উপর। তবে—
তবে কী?
কোনো এডভান্স দিতে পারব না। কাজ শেষ হলে টাকা পাবে।
শান্ত ভুরু কুচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, ঠিক তো? পরে ফাকি দিবি না তো?
টুনি মুখ শক্ত করে বলল, কখনো দিয়েছি? শান্ত বলল, ঠিক আছে কী করতে হবে বল।
টুনি তার কাজটা ব্যাখ্যা করতে থাকে আর সাথে সাথে শান্তর মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠতে থাকে। এই হাসি দেখে যে কোনো স্বাভাবিক মানুষের ভয় পেয়ে যাবার কথা।
বিকেলবেলা গাবড়া বাবার ঘরে তনু, তনুর মা ছাড়াও ছোটা আর ফারিহা বসে আছে। গাবড়া বাবার সামনে একটা মাটির মালশা থেকে ধােয়া বের হচ্ছে। ঘরের সব জানালার সব পর্দা টেনে রাখা হয়েছে, দরজাও বন্ধ তাই ঘরের মাঝে আবছা অন্ধকার। সামনে একটা মোমবাতি জ্বলছে। গাবড়া বাবার শরীরে কালো আলখাল্লা, একটা লাল চাদর গলা থেকে ঝুলছে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গাবড়া বাবা হঠাৎ হুম-ম-ম-ম করে একটা শব্দ
করল, সেই শব্দ শুনে ছোটাচ্চু রীতিমতো চমকে উঠল।
গাবড়া বাবা হঠাৎ তার লাল চোখ খুলে সবাইকে এক নজর দেখে নিল, তারপর বলল, কেউ কথা বলবা না। তাহলে আত্মার কষ্ট হবে। আত্মা আসতে পারবে না। আবার আসলে যেতে পারবে না। মহাবিপদ হয়ে যাবে।
সবাই এমনিতে চুপ করে বসেছিল, এখন আরো চুপ করে গেল, মনে হল শ্বাস প্রশ্বাসও নিতে লাগল নিঃশব্দে। গাবড়া বাবা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল তারপর হঠাৎ থরথর করে কাঁপতে লাগল, মুখ দিয়ে নানারকম বিচিত্র শব্দ করতে লাগল তারপর হঠাৎ কাঁপুনি থামিয়ে সোজা হয়ে বসে নাকি সুরে বলল, নিলু। নিলু তুমি কই?
নিলু নিশ্চয়ই তনুর মায়ের নাম, একেবারে ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে বললেন, এই যে, এই যে আমি।
আমি আনোয়ার।
তনুর মা বললেন, জানি। আমি জানি।
আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে নীলু। অনেক কষ্ট।
কেন? কষ্ট কেন? তনুর মা একেবারে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।
পৃথিবীর মায়া আমাকে বড় কষ্ট দেয়। তোমার কথা তনুর কথা আমি ভুলতে পারি না। তাই বারবার তোমাদের কাছে আসি।
ছোটাচ্চু গাবড়া বাবার ফিচলে কথা শুনে মুগ্ধ হল। লোকটা যত বড় ক্রিমিনালই হোক কথা বলে গুছিয়ে।
তনুর মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, বললেন, তোমার কথাও আমরা ভুলতে পারি না। গাবড়া বাবা আছে বলে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারি। মনটা শান্ত হয়।
গাবড়া বাবা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, নীলু। তোমার মনটা শক্ত কর। এখন তোমাকে আমি একটা কথা বলব।
কী কথা।
আমার সাথে কুলসুমের দেখা হয়েছে।
ছোটাচ্চু আবছা অন্ধকারে মুচকি হাসল। গাবড়া বাবা ফাঁদে পা দিচ্ছে। স্টিং অপারেশন শুরু হয়ে গেছে।
তনুর মা অবাক হয়ে বললেন, কুলসুম? কুলসুম কে?
তুমি কুলসুমকে চিন না। তার কারণ আমি তোমাকে কোনোদিন কুলসুমের কথা বলি নাই। কুলসুম আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রী।
তনুর মা চমকে উঠে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন, বললেন, তোমার আগের পক্ষের স্ত্রী আছে?
গাবড়া বাবা নাকি সুরে বলল, হ্যাঁ নিলু। তোমাকে আগে কখনো বলি নাই, আজকে বলি। তোমাকে বিয়ে করার আগে আমি আরেকটা বিয়ে করেছিলাম, তার ঘরে আমার একটা ছেলেও আছে। ছেলেটার নাম রাজু।
ছেলে? রাজু?
হ্যাঁ। তারা তোমার কাছে আসবে।
আসবে?
হ্যাঁ। সম্পত্তির জন্যে মামলা করবে সাবধান।
কথা শেষ করে গাবড়া বাবা হঠাৎ আবার থরথর করে কাঁপতে শুরু করল, তারপর ধড়াম করে উপুড় হয়ে পড়ে গেল।
রে বসে থাকে তারপর তনুর মা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন, কী আশ্চর্য!