মনে থাকলে–
আমি মনে করিয়ে দেব। বইটা স্পেশাল।
বিজ্ঞানের একটা বই আবার স্পেশাল হয় কেমন করে? গল্প উপন্যাস হলে তবু একটা কথা ছিল।
ছোটাচ্চুর বিজ্ঞান নিয়ে একটা এলার্জির মতো আছে, টুনি সেটা খুব ভালো করে জানে। বইটা এখন ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি। টুনি হালকা একটু দুশ্চিন্তা নিয়ে তার মাথা চুলকাতে থাকে।
পরের দিন গাবড়া বাবাকে নিয়ে স্টিং অপারেশান শুরু করার কথা। ফারিহা ছোটাচ্চুর কথামতো নাটকদলের সেই ছেলেটাকে রাজি করিয়েছে। বিকেলবেলা তনুর মা গাবড়া বাবার জন্যে বাজার করতে কাঁচা বাজারে যাবেন, ঠিক তখন এই ছেলেটা তনুদের বাসায় যাবে। গাবড়া বাবার তখন ধ্যান করার কথা, বাসা নীরব থাকে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বললে গাবড়া বাবা শুনতে পাবে। টুনির পুরো ঘটনাটা দেখার ইচ্ছা ছিল কিন্তু তার কোনো উপায় নেই। যখন গাবড়া বাবার জন্যে এই নাটকটা হবে তখন সেখানে তনু ছাড়া আর কেউ থাকবে না। ছোটাচ্চু আর ফারিহা পর্যন্ত বাইরে একটা চায়ের দোকানে অপেক্ষা করবে।
নাটকের ছেলেটাকে নিয়ে ছোটাচ্চু আর ফারিহা বাইরে অপেক্ষা করছিল, যখন দেখল তনুর মা হাতে একটা ছাতা আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলেন তখন নাটকের ছেলেটা ভেতরে ঢুকলো। আগে থেকে ঠিক করা ছিল, বেশ কয়েকবার কলিংবেল টেপার পর তনু দরজা খুলল, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা তার নাটকের গলায় জিজ্ঞেস করল, এইটা কি আনোয়ার সাহেবের বাসা?
তনুর বাবার নাম আনোয়ার হোসেন। তনু বলল, জি।
আমি কি ভিতরে আসতে পারি?
আসেন।
নাটকের ছেলেটা ভিতরে ঢুকলো, বসার ঘরে একটু হাঁটল। গাবড়া বাবার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ভেতরে ধোঁয়া কেন?
তনু বলল, সেটা অন্য ব্যাপার। আপনি কার কাছে এসেছেন?
নাটকের ছেলেটা হা হা করে হাসল, বলল, কী আশ্চর্য! আমি আমার নিজের বাসায় আসতে পারব না?
তনু অভিনয় করে না, তবু আশ্চর্য হবার অভিনয় করে বলল, নিজের বাসা?
গাবড়া বাবার ঘরের ভেতর হালকা শব্দ হচ্ছিল, হঠাৎ করে ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে গেল। বাইরের ঘরে কী নিয়ে আলাপ হচ্ছে গাবড়া বাবা নিশ্চয়ই শোনার চেষ্টা করছে।
নাটকের ছেলেটা স্টেজের এক মাথা থেকে হলঘরের অন্য মাথায় পৌছে দেবার মতো তেজি গলার স্বরে বলল, হ্যাঁ। এইটা আপনার যেরকম বাসা, আমারও সেইরকম বাসা। আনোয়ার হোসেন আমার বাবা।
তনু অতি অভিনয় করে বলল, বাবা?
হ্যাঁ। আমার মা হচ্ছেন আপনার বাবার প্রথম স্ত্রী। আমি তার প্রথম স্ত্রীর ছেলে। তার মানে আপনি আমার ছোট বোন। ছোট বোনকে আপনি করে বলতে হবে কেন? আমি তুমি করে বলব। তুমি আমার ছোট বোন। তুমি তুমি তুমি।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
নাটকের ছেলেটা অপূর্ব অভিনয় করে বলল, তোমরা আমাদের দুঃখ কোনোদিন বুঝবে না। আমার মা খুব সাধারণ একটা মেয়ে ছিল। আমার জন্মের পর তোমার বাবা আমার মাকে ছেড়ে এসে তোমার মাকে বিয়ে করেছে। আমার মা কতো কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে তুমি জান?
তনু বলল, আমি বিশ্বাস করি না।
নাটকের ছেলেটা নাটকীয় ভঙ্গিতে হা হা করে হাসল, বলল, আমি জানি তোমরা বিশ্বাস করবে না, সে জন্যে আমি সাথে করে প্রমাণ নিয়ে এসেছি।
কী প্রমাণ? এই দেখ।
তখন নাটকের ছেলেটা একটা খাম বের করে সেখান থেকে কয়েকটা ফটো বের করার ভান করল। গলা উঁচিয়ে বলল, এই দেখ আমার মায়ের বিয়ের ছবি। তোমার বাবাকে চিনতে পারছ?
হ্যাঁ। আসলেইতো এটা আমার বাবা, কী আশ্চর্য!
পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা কি তোমার মা?
তনু বলল, না।
এটা আমার মা। কুলসুম বেগম।
তনু বলল, কুলসুম?
ছেলেটা খাম থেকে আরো কিছু কাগজ বের করল, বলল, এই দেখো আমার মাকে লেখা বাবার চিঠি। হাতের লেখা চিনতে পারো? কার হাতের লেখা এটা?
আমার বাবার।
কী লিখেছ দেখেছ? কুলসুম, আমি দুঃখিত তোমার সাথে আমার আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব না। রাজুকে দেখেশুনে রেখো–
রাজু কে?
আমি। আমার নাম রাজু।
তনু বলল, এই ফটো, চিঠিপত্রগুলো আমাকে দেবে?
নাটকের ছেলেটা গমগমে গলায় বলল, না। এগুলো এখন আমি তোমাকে দেব না। তোমরা যদি নিজেরা আমাকে গ্রহণ করে নাও ভালো,
কোর্টে যেতে হয় তাহলে এগুলো হবে আমার একমাত্র প্রমাণ। তোমার মা কোথায়?
নাটকের ছেলেটা গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার মা গত বছর মারা গিয়েছেন। হয়তো পরকালে বাবা শেষ পর্যন্ত মাকে গ্রহণ করেছেন। কে বলতে পারবে? কে উত্তর দেবে?
তুমি এখন কী চাও?
তোমার বাবার সন্তান হিসেবে আমি আমার অধিকার চাই।
কীভাবে?
তোমার সাথে যেভাবে কথা বলেছি, সেভাবে তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাই।
তনু মাথা নেড়ে বলল, না, না। এখন আমার মাকে এটা বলা যাবে। আমার মা তাহলে একেবারে ভেঙে পড়বে।
আগে হোক পরে হোক এটা তোমার মাকে বলতেই হবে।
তনু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এই বিষয়টার কথা আর কে কে জানে?
মায়ের আত্মীয় স্বজনেরা জানতো, তারা কেউ বেঁচে নেই। মা বেঁচে নেই তাই আমি ছাড়া কেউ জানত না। এখন তুমি জানো।
আর কেউ?
না। আর কেউ জানে না। আমার বাবা জানতো, কিন্তু সে তো আর এটা বলার জন্যে ফিরে আসবে না।
তনু কোনো কথা বলল না, নাটকের ছেলেটা যেরকম নাটকীয় ভাবে এসেছিল ঠিক সেরকম নাটকীয়ভাবে চলে গেল। তনু কিছুক্ষণ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল, শুনতে পেলো গাবড়া বাবা দরজার কাছ থেকে সরে গেল। ধুরন্ধর মানুষটা সবকিছু শুনেছে। তনু একটু এগিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিল। ঘরের মাঝখানে গাবড়া বাবা পদ্মাসনে ধ্যান করার ভঙ্গিতে বসে আছে। দেখে মনে হবে কিছু শুনে না, কিছু জানে না।