পরদিন বিকাল বেলা টুনি ছোটাচ্চুর সাথে রওনা দিল, হাতে একটা মোটা বই। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, কীসের বই এটা।
বিজ্ঞানের।
তুই কবে থেকে বিজ্ঞানের বই পড়া শুরু করেছিস?
আজকে থেকে।
ঢং করিস?
না ছোটাচ্চু! ঢং করব কেন? আমার কি বিজ্ঞানের বই পড়ার ইচ্ছা করতে পারে না?
ছোটাচ্চু কোনো কথা বলল না, গজগজ করতে লাগল। ছোটাচ্চু কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না যে, টুনি ইচ্ছে করে একটা বিভানের বই হাতে নিয়ে রওনা দিয়েছে কোন ছোটাচ্চু বইটা হাতে ন! নেয়।
তনুদের বাসার সানে গিয়ে ছোটা তনকে ফোন করল। তনু তখন নিচে নেমে এসে ছোটাকে উপরে নিয়ে গেল। ছোটা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার আম্মু বাসায় আছেন?
তনু বলল, হ্যাঁ। আছে।
কী করছেন?
গাবড়া বাবার জন্যে রাধছেন। গাবড়া বাবার পাঙাস মাছ খাওয়ার সখ হয়েছে।
গাবড়া বাবা কী করছে?
ধ্যান করছে।
আজ রাতে কি থাকবে তোমাদের বাসায়?
মনে হয় থাকবে।
দোতলার একটা ফ্ল্যাটে তনু তার মাকে নিয়ে থাকে। বসার ঘরেই ধূপের ঝাঝালো গন্ধ। পাশে একটা ঘরের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হয়ে আসছে। তনু ফিস ফিস করে বলল, এই ঘরে গাবড়া বাবা আছে।
আমরা কি দেখা করতে পারি? দাঁড়াও, মাকে বলে আসি। মা তার গাবড়া বাবাকে দেখে শুনে রাখে
ঠিক আছে, যাও, আমরা এখানে বসি।
ছোটাচ্চু আর টুনি সোফায় বসল, তনু তখন ভেতরে গেল তার মাকে ডাকতে। কিছুক্ষণের মাঝেই আঁচলে হাত মুছতে মুছতে তনুর মা বের হয়ে এলেন, রান্না করছিলেন বলে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কপালের দুই পাশের চুল পাকতে শুরু করেছে। ছোটাচ্চুকে দেখে জ্বলজ্বলে চোখে বললেন, তোমরা বুঝি গাবড়া বাবাকে দেখতে এসেছ?
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, জি। তনুর কাছে শুনেছি। আমার ভাতিজিকে নাচের স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন মনে হল গাবড়া বাবাকে এক নজর দেখে যাই।
একেবারে সত্যিকারের সিদ্ধপুরুষ। আমাদের কতো বড় সৌভাগ্য এখানে পায়ের ধুলো দিয়েছেন।
ছোটাচ্চু বলল, ও।
বাবা ধ্যান করছিলেন। ধ্যানের সময় বাবাকে ডিস্টার্ব করা ঠিক না।
ছোটাচ্চু বলল, ও।
তোমাদের কারো সাথে যোগাযোগ করতে হবে?
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, না।
আগে মনে হতো জীবন আর মৃত্যু বুঝি একেবারে আলাদা। বাবার সাথে পরিচয় হবার পর বুঝেছি কোনো পার্থক্য নাই। যখন খুশি দেহান্তরিত মানুষের সাথে কথা বলা যায়। পরকালটা যেন পাশের একটা ঘর।
ছোটাচ্চু বলল, ও। তনুর বাবা এখন নিয়মিত আমার সাথে যোগাযোগ করে। গাবড়া বাবা থাকলে যে কী হতো।
ছোটাচ্চু আবার বলল, ও।
ঠিক এই সময় পাশের ঘর থেকে একটা বিকট শব্দ শোনা গেল, আর তনুর মা তখন ছটফট করে উঠে বললেন, বাবার ধ্যান ভেঙেছে। যাই আমি বাবার জন্যে দুধ নিয়ে আসি।
তনুর মা প্রায় ছুটে গিয়ে একটু পরে বিশাল একটা মগে করে দুধ নিয়ে এলেন। ছোটাচ্চুকে বললেন, এসো আমার সাথে। বাবার পা ধরে সালাম করো, তোমার জন্যে দোয়া করবেন।
তারপর টুনির দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, তুমিও ভিতরে যাবে?
টুনি ছোটাচ্চুকে কথা দিয়েছিল যে, সে একটা কথাও বলবে না। তাই সে কথা বলল না, মাথা নেড়ে তনু মাকে জানাল সেও গাবড়া বাবার সাথে দেখা করতে চায়।
তনুর মা দরজা একটু ফাঁক করে বললেন, বাবা, আপনার ধ্যান শেষ হয়েছে?
গাবড়া বাবা সোজা হয়ে বসেছিল, চোখ খুলে বলল, হাম্মম্। হামম্ বলে কোনো শব্দ ছোটাচ্চু কিংবা টুনি কেউই শোনে নি। তনুর মা মনে হল এই শব্দের সাথে পরিচিত, দুধের মগ নিয়ে ভিতরে ঢুকে বলল, বাবা, আপনি এখন একটু দুধ খান।
গাবড়া বাবা বলল, গামম!
এই শব্দটাও মনে হয় তনুর মা বুঝে গেলেন, তাড়াতাড়ি দুধের মগটা গাবড়া বাবার পায়ের কাছে রেখে বললেন, এই দুইজন আপনার দোয়া নিতে এসেছে বাবা।
গাবড়া বাবা মুখ তুলে এবারে ছোটাচ্চু আর টুনির দিকে তাকাল, তখন তারা তাকে প্রথমবার ভালো করে দেখতে পেল। মাথায় কুচকুচে কালো লম্বা আর ঘন চুল। মুখে তার থেকেও কালো ঘন লম্বা দাড়ি। চুল দাড়ির জঙ্গলে গাবড়া বাবার চেহারাটাই ভালো করে দেখা যায় না। চাপা নাক আর ঘন ভুরু। চোখ দুটো টকটকে লাল। কপালে টকটকে লাল সিঁদুর। কালো একটা আলখাল্লা পরে আছে। সামনে একটা মাটির মালশা সেখানে এক খাবলা ধূপ দিতেই কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হয়ে এলো।
তনুর মা ফিস ফিস করে বললেন, বাবাকে সালাম করো।
ছোটাচ্চুর সালাম করার কোনো ইচ্ছে ছিল না কিন্তু তনুর মাকে খুশি। করার জন্যে এগিয়ে গিয়ে গাবড়া বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করল। টুনির হাতে বিজ্ঞানের মোটা বই, সেটা ঘরের কোনায় শেলফে রেখে নিচু হয়ে গাবড়া বাবাকে সালাম করার ভঙ্গি করল। গাবড়া বাবা হুংকার দিয়ে বলল, হামমুম্।
মনে হল তনুর মা এই কথাটাও বুঝে ফেললেন। বুঝে ঝলমলে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, তোমাদের আর কোনো চিন্তা নাই, গাবড়া বাবা তোমাদের জন্যে দোয়া করে দিয়েছেন।
ঘরের ভেতর ধোয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তাই ছোটাচ্চু আর বেশিক্ষণ থাকার চেষ্টা করল না, টুনির হাত ধরে বের হয়ে এল। বাসার কাছাকাছি পৌঁছানোর পর টুনি বলল, ছোটাচ্চু, আমার বিজ্ঞানের বইটা আমি গাবড়া বাবার রুমে ফেলে এসেছি।
ছোটাচ্চু বলল, এখন বলছিস? আগে বললি না কেন?
আগে মনে ছিল না।
এখন আমি তোর বইয়ের জন্যে ফিরে যেতে পারব না।
টুনি বলল, এখন যেতে হবে না, কিন্তু পরের বার তুমি যখন তনু আপুর বাসায় যাবে তখন নিয়ে এসো।