ছোটাচ্চুকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে একজন জিজ্ঞেস করল, তুমি রিভলবার কিনবে না? না হলে পিস্তল। সব সময় ডিটেকটিভদের পিস্তল, না হলে রিভলবার থাকে। যে জিজ্ঞেস করল সে এই বাসায় সবচেয়ে নিরীহ ধরনের ছোট একটা শান্তশিষ্ট মেয়ে।
ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, রিভলবার?
হ্যাঁ। আমি সিনেমায় দেখেছি ডিটেকটিভরা গুলি করে সব সময় মগজ বের করে দেয়। তুমি কি গুলি করে মগজ বের করবে?
ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, তোদের আমি বিষয়টা বোঝাতেই পারলাম না। এটা মোটেও নাটক-সিনেমা না। এটা গল্প উপন্যাস না। এটা সত্যিকারের সার্ভিস। বাংলাদেশে এখনো নাই, আমি প্রথম শুরু করতে যাচ্ছি। সিনেমাতে ডিটেকটিভদের রিভলবার-পিস্তল থাকে। আমার সেগুলো লাগবে না। আমার দরকার খালি বুদ্ধি।
ত্যাঁদড় মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, তোমার বুদ্ধি আছে?
ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, যেকোনো মানুষ থেকে বেশি। খালি বুদ্ধি, আমার আছে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, বিশ্লেষণী মস্তিষ্ক এবং নিরলস পরিশ্রম করার আগ্রহ।
এই রকম কঠিন কঠিন কথাগুলোর অর্থ কী বাচ্চাদের বেশির ভাগই বুঝতে পারল না। তারা অবশ্যি সেটা নিয়ে মাথাও ঘামাল না। একজন জিজ্ঞেস করল, আমাদের নেবে না?
আঠারো বছরের কম কাউকে নেওয়া যাবে না।
হাসিখুশি ধরনের একজন বলল, আমি আর টুম্পা দুইজন মিলে আঠারো।
দুইজন মিলে আঠারো হলে হবে না। একজনকে আঠারো হতে হবে।
যখন তারা বুঝতে পারল ছোটাচ্চু তাদের নেবে না, তখন তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করল। তারা যখন উঠে চলে যেতে শুরু করল, ছোটাচ্চু তখন আবার সবাইকে মনে করিয়ে দিল, মনে থাকবে তো? এটা এখনো সিক্রেট। কাউকে বলা যাবে না।
সবাই মাথা নাড়ল এবং একটু পরেই তারা অন্যদের ছোটাচ্চুর ডিটেকটিভ এজেন্সির কথা বলতে লাগল। তারা কথা বলল ফিসফিস করে আর বলার আগে কিরা কসম খাইয়ে নিল যেন কথাটা অন্য কাউকে না বলে। দাদি জানতে পারলেন পনেরো মিনিটের মধ্যে। শুনে মুখ টিপে হাসলেন। বড়মামা জানতে পারলেন রাত্রে ঘুমানোর আগে। শুনে হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, এই শাহরিয়ারটা আর কোনোদিন বড় হল না!
০২. ছোটাচ্চু তার ঘরে
ছোটাচ্চু তার ঘরে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে হলুদ বইটা পড়ছে, তার চারপাশে কাগজপত্র ছড়ানো। পড়তে পড়তে মাঝে মাঝেই ছোট একটা নোটবইয়ে কিছু একটা লিখছে। এ রকম সময়ে টুনি এসে ঘরে ঢুকল।
এই বাসার অসংখ্য বাচ্চার সবার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু মনে হয় টুনির কথা আলাদা করে বলে রাখা ভালো। টুনির বয়স এগারো, ছোটখাটো সাইজ, তাই দেখে মনে হয় বয়স বুঝি আরও কম। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে তার মুখের দিকে তাকালে সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, সেখানে এমন এক ধরনের গাম্ভীর্য আছে যে দেখে মনে হয় সে বুঝি বয়স্ক একজন মানুষ। এই বাসার বাচ্চাকাচ্চাদের লেখাপড়ায় বেশি আগ্রহ নাই তাই তাদের কারও চোখে চশমা নাই—টুনি ছাড়া। তার চশমাটি মোটেও বাচ্চাদের চশমা নয়, চশমার দোকান থেকে বেছে বেছে সে বুড়াে মানুষের গোল গোল মেটাল ফ্রেমের চশমা কিনেছে, সেই চশমায় তাকে আরও বয়স্ক দেখায়। সে কথা বলে কম, যখন বলে তখন অল্প দুই-চারটা শব্দ দিয়ে সবকিছু বলে ফেলে। যখন কথা বলে না তখন ঠোঁট দুটি চেপে রাখে, যেন মুখের ভেতর থেকে তার অজান্তে কোনো কথা বের না হয়ে যায়। টুনির চুলগুলো অনেকটা পুতুলের চুলের মতো, মাথার দুই পাশে দুটি ঝুঁটি এবং সেগুলো লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা।
ছোটাচ্চুর ঘরে ঢুকে টুনি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা পর্যন্ত সে কোনো কথা বলে না। ছোটাচ্চু তার হলুদ বইয়ে এত বেশি ডুবে ছিল যে প্রথমে টুনিকে লক্ষই করেনি। যখন লক্ষ করল তখন মুখ তুলে বলল, টুনটুনি!
মন মেজাজ ভালো থাকলে ছোটাচ্চু মাঝে মাঝেই টুনিকে টুনটুনি ডাকে কিন্তু টুনির নাম যেহেতু টুনটুনি না, তাই তাকে টুনটুনি ডাকা হলে সে সাধারণত উত্তর দেয় না। এবারও সে উত্তর দিল না। তার গোল গোল চশমার ভেতর দিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু তখন একটু গতমত খেয়ে বলল, কিছু বলবি?
টুনি মাথা নেড়ে জানাল যে, সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু কিছু না বলে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ছোটাচ্চু তখন বলল, কী বলবি? বল।
টুনি কম কথার মানুষ, তাই সে কম কথায় বলল, আমিও ডিটেকটিভ হব।
ছোটাচ্চু একটু হকচকিয়ে গেল, বলল, কী হবি?
টুনি উত্তর দিল না, সে কী বলেছে ছোটাচ্চু ভালো করে শুনেছে, তাই আরও একবার একই কথা বলার কোনো অর্থ নেই। সে কখনো বাড়তি কথা বলে না।
ছোটাচ্চু তখন বলল, তুই ডিটেকটিভ হবি? ডিটেকটিভ হওয়া এত সোজা!
টুনি বলল, তুমি যদি হতে পারো এটা নিশ্চয় সোজা। ছোটাচ্চু কেমন জানি চিড়বিড় করে জ্বলে উঠল, কী বললি, কী বললি
তুই?
টুনি কোনো কথা বলল না, তার হিসাবে ছোটাচ্চুর এই কথাটার উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। সে যে কথাটা বলেছে সেটা না বোঝার কোনো কারণ নাই। ছোটাচ্চু তখন গলা উঁচিয়ে বলল, তোরা ভেবেছিস কী? আমি একটা খেলা খেলছি? ডিটেকটিভ ডিটেকটিভ খেলা?
টুনি ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল, বুঝিয়ে দিল যে সে এটাকে খেলা ভাবছে না।
ছোটাচ্চু আরও গলা উঁচিয়ে বলল, তাহলে? তাহলে তুই ডিটেকটিভ হবি এই কথাটার মানে কী?