বাহান্ন।
মাত্র বাহান্ন? আহা! কী হয়েছিল?
ডাক্তারেরা পরিষ্কার করে ধরতে পারিনি। ব্লাড ক্যান্সারের মতো আবার পুরোপুরি ব্লাড ক্যান্সার না। যাই হোক, বাবাকে বেশিদিন ভুগতে হয়নি, বাবা যখন বুঝতে পারলেন তখন সেই অসুস্থ অবস্থাতেই আমার মায়ের জন্যে সবকিছু গুছিয়ে দিলেন। ব্যাংক একাউন্ট, ফ্ল্যাটের কাগজপত্র পেনশনের নমিনি সবকিছু। এমন কী বেশিদিন হাসপাতালে থাকতেও রাজি হননি, শুধু শুধু টাকা নষ্ট হবে, তাই।
যাই হোক, বাবা মারা যাবার পর স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের খুব মন খারাপ হল। আমাকে অবশ্যি খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিতে হল মায়ের জন্যে। মা একেবারে ভেঙে পড়লেন, ব্যাপারটা মানতেই পারেন না। বলা যেতে পারে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলেন, সারারাত জেগে বসে থাকেন। তার ধারণা হতে থাকল আমার বাবার আত্মা তার সাথে যোগাযোগ করতে আসছেন। মা পরলোক নিয়ে চর্চা করতে লাগলেন। ঠিক তখন সর্বনাশটা হল।
তনু চুপ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, কী সর্বনাশ হল?
মা ইন্ট্রোভার্ট ধরনের মানুষ, বাইরে খুব যোগাযোগ নেই। সেই সাদাসিধে মা ফেস বুক একাউন্ট খুলে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন, কারা মৃত মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। আর ঠিক ঠিক মানুষজন পেতেও লাগলেন, তারা মাকে নানা ধরনের খবর দিতে লাগল। যে যেটা বলে মা সেটা বিশ্বাস করে বসে থাকেন। আর তখন একেবারে খাটি একটা ক্রিমিনাল এসে হাজির। এই দাড়ি, এই চুল, চোখ টকটকে লাল। কালো আলখাল্লা গলায় লাল শালুর চাদর। কীভাবে যে মায়ের খোঁজ পেয়েছে কে জানে, মাকে বোঝাল সে বাবার আত্মাকে হাজির করে দেবে। মাও বিশ্বাস করে বসে থাকলেন। লোকটার চেহারা রাসপুতিনের মতো, কাজকর্মও সেইরকম। অনেক রকম ভড়ং চড়ং করে তারপর তার ওপর বাবার আত্মা এসে ভর করে, মায়ের সাথে কথা বলে প্রথম প্রথম শুধু পরকালের খবরাখবর এনে দিত। আজকাল বাবার আত্মা মাকে উপদেশ দিতে শুরু করেছে। টাকা পয়সা ব্যাংক ব্যালেন্স এসব নিয়ে কথা বলছে।
ছোটাচ্চু বলল, সর্বনাশ!
হ্যাঁ সর্বনাশ। আমাদেরকে না জানিয়ে মা মনে হয় এই লোককে টাকা পয়সাও দিয়েছে। কিন্তু সেইটা সর্বনাশ না। সর্বনাশ হচ্ছে এই লোেক এখন মাঝে মাঝেই আমাদের বাসায় রাত কাটাতে শুরু করেছে। ঘরের মাঝে ধূপ ধূনা জ্বালিয়ে কাপালিক সাধনা শুরু করেছে। মাকে কিছুই বোঝানো যায় না—এই ক্রিমিনালের পা ধরে বসে থাকে।
ছোটাচ্চু জিভেস করল, তোমার মাকে কী বলে এইভাবে বশ করেছে?
তনু বলল, লোকটা মহা ধুরন্ধর। মায়ের সাথে যোগাযোগ করার আগে একটু খোঁজ খবর নিয়ে এসেছে। বাবা কোথায় কাজ করতো, কোন হাসপাতালে ছিল, তার আয় • কারা এরকম। তারপর এই ফ্যাক্টগুলো সে ব্যবহার করে। আমাদের কথা খুব মন দিয়ে শোনে, সেখানে যেগুলো শোনে সেগুলো মনে রাখে, আগে পিছে কিছু একটা লাগিয়ে নিয়ে ব্যবহার করে। লোকটার অসম্ভব বুদ্ধি মাঝে মাঝে রিস্ক নিয়ে কিছু একটা বলে যদি মিলে যায় তাহলে তো কথাই নাই—যদি টের পায় মিলছে না তখন কথাটা ঘুরিয়ে ফেলে।
ফারিহা বলল, কী সর্বনাশ!
তনু বলল, এখন আমাদের সেফটি নিয়ে দুশ্চিন্তা। কোনো এক রাতে আমাদের জবাই না করে চলে যায়। মাকে বলাই যায় না, বাবা বাবা করে অজ্ঞান।
ফারিহা বলল, তুমি এখন শাহরিয়ারকে কী করতে চাও বল।
এই লোকটার খোঁজ খবর নিয়ে আমাদেরকে দেয়া। মাকে বোঝাব-দরকার হলে পুলিশে খবর দেব।
ছোটাচ্চু দুশ্চিন্তিত মুখে মাথা চুলকালো। বলল, হুম। ফারিহা ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, পারবে?
ছোটাচ্চু চেষ্টা করল জোর দিয়ে বলতে, অবশ্যই পারব। কিন্তু গলায় খুব জোর পেল না। মাথা চুলকে বলল, লোকটার ছবি আছে? নাম ঠিকানা।
ঠিকানা নাই, তার কারণ সে নাকি ঘর বাড়ি ঠিকানা বিশ্বাস করে না। নাম গাবড়া বাবা।
গাবড়া?
হ্যাঁ,গাবড়া, গাবড়া বাবা। আর ছবি?
তনু তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল, আমি গোপনে ছবি তুলেছি। এই হচ্ছে সেই লোক–
তনু তার মোবাইল টেলিফোনে লোকটার ছবি দেখাল আর সেই ছবি দেখে ছোটাচ্চু আর ফারিহা দুজনেই মনে হল ভয়ে আঁতকে উঠল।
এর পর আরো কিছু সময়ের ভিডিও আছে কিন্তু সেখানে কীভাবে কী করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা, টুনি সেটাও মন দিয়ে শুনল। যখন ভিডিওটা শেষ হল তখন সে কম্পিউটারটা বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে
এল। শান্তর আম্মু রান্না ঘর থেকে বললেন, কে? টুনি নাকি?
জি চাচী।
চলে যাচ্ছিস?
জি চাচী।
ফুচকা বানিয়েছি, খেয়ে যা।
টুনি খুব সখ করে বেশ কয়েকটা ফুচকা খেলো।
চাচী জিভেস করল, কেমন হয়েছে?
টুনি বলল, অসাধারণ! একেবারে রাস্তার ফুচকার মতো!
চাচী হেসে টুনির মাথায় একটা ঢার্টি দিলেন, বললেন, রাস্তার মতো?
জি চাচী। রাস্তার ফুচকা হচ্ছে বেট! তুমি একটা টং ভাড়া করে আমাদের স্কুলের সামনে বসে যাও, দুইদিনে বড়লোক হয়ে যাবে।
চাচী আবার টুনির মাথায় চাটি দিলেন।
একটু পর টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে উঁকি দিল। ছোটাচ্চু বিছানায় পা তুলে বসে আছে তার চোখে মুখে এক ধরনের উত্তেজনার ভাব, চোখগুলো জ্বল জ্বল করছে। টুনিকে দেখে চোখের জ্বল জ্বলে ভাবটা আরেকটু বেড়ে গেল, বলল, টুনি? তুই।
টুনি মাথা নাড়ল, তোমার ভিডিও ক্যামেরাটা। ড্রয়ারে রেখে দেব?
ছোটাচ্চু বললেন, দে। রেখে দে।