ছোটাচ্চু বলল, বলছি, কিন্তু এই কেসটা নিয়ে আমি একটা সমস্যায় পড়ে গেছি।
আকবর হোসেন জিজ্ঞেস করলেন, কী সমস্যা?
আমার কাজের জন্যে সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। সাংবাদিকেরা এটার খোঁজ পেয়ে গেছে, এখন তারা এটা নিয়ে একটা স্টোরি করতে চায়। পজিটিভ স্টোরি করলে আমার কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু স্টোরিটা নেগেটিভ, আমি যখন আমার ডিটেকটিভ এজেন্সিটাকে দাঁড়া করতে চাইছি এই সময়ে যদি নিগেটিভ স্টোরি করে–
ফারিহা এই সময় ছোটাচ্চুকে থামিয়ে বলল, আমি বিষয়টা বুঝিয়ে বলি। স্টোরি নেগেটিভ হয় না, পজিটিভও হয় না। স্টোরি হয় সত্যি। কাজেই আমরা সত্যি কথাটা বলতে চাই। সত্যি কথা হচ্ছে একটা মেধাবি ছেলে বিজ্ঞানকে ভালোবাসে কিন্তু তার পরিবার তাকে বিজ্ঞান পড়তে দিবে না। তাকে বলা হয়েছে যদি তাকে বিজ্ঞান পড়তে হয়, নিজের উপার্জনে পড়তে হবে। ছেলেটি বিজ্ঞানকে এতো তীব্রভাবে ভালোবাসে যে, সে বাসা ছেড়ে চলে গেছে নিজে নিজে উপার্জন করে পড়ছে। আমরা এই সত্যি কথাটা বলতে চাই। যে পরিবার তাকে ঘর ছাড়া করেছে—
সুমনের মা তীব্র গলায় চিৎকার করে বললেন, মা, তুমি পরিবার বল না। আমরা কিছু করিনি, সবকিছু করেছে সুমনের বাবা- আঙুল দিয়ে আকবর হোসেনকে দেখিয়ে বললেন, এই বাবা। আমরা কতো বোঝানোর চেষ্টা করেছি। বুঝে নাই। ছেলেটাকে ঘর ছাড়া করেছে।
ফারিহা ব্যাগ থেকে একটা নোট বই বের করে দ্রুত লিখতে থাকে, মুখ গভীর করে বলল, তাহলে বাবার একার ইচ্ছা? এখানে পরিবারের অন্য সদস্যদের মতামতের কোনো গুরুত্ব নাই?
আকবর হোসেন অস্বস্তিতে নড়ে চড়ে বললেন, আমি ঠিক এই সব ব্যক্তিগত তথ্য পত্র পত্রিকায় দেখতে চাই না।
ছোটাচ্চু বলল, আমিও চাই না। কিন্তু এখন সাংবাদিকেরা খবর পেয়ে গেছে। আমার পিছনে চিনে জোঁকের মতো লেগে গেছে—
ফারিহা হুংকার দিয়ে ছোটাচ্চুকে বলল, আপনি কী বললেন? আমাকে চিনে জোঁক বললেন?
ছোটা বলল, না মানে ইয়ে—আক্ষরিক ভাবে বলি নাই। কথার কথা বলতে গিয়ে—
ফারিহা আরো জোরে হুংকার দিল, কথার কথা বলতে গিয়ে আপনি অপমান সূচক কথা বলবেন? আপনি এই মুহূর্তে কথাটা প্রত্যাহার করেন তা
হলে আপনার বিরুদ্ধে, আপনার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিব।
ফারিহার অভিনয় দেখে ছোটাচ্চু মুগ্ধ হল। সেও অভিনয়ের চেষ্টা করতে লাগল, বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি চিনে জোঁক কথাটা প্রত্যাহার করলাম। আমি বরং বলি আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করছেন।
ফারিহা মুখ শক্ত করে বলল, থ্যাংকু।
ছোটাচ্চু আবার আকবর হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা ভালো কাজ করতে গিয়ে আমি বিপদের মাঝে পড়ে গেছি। সাংবাদিকেরা পত্রিকায় রিপোর্ট করার সময় আমার নাম দিয়ে দেবে, সবাইকে বলবে আমি টাকার বিনিময়ে মেধাবী বিজ্ঞান পিপাসু একটা ছেলেকে তার নিষ্ঠুর বাবার হাতে তুলে দিয়েছি। ভবিষ্যতে আমার একটা খারাপ পাবলিসিটি হয়ে যাবে। আমি সেটা চাই না।
আকবর হোসেন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী চান?
আপনি এই সাংবাদিকের বোঝান তারা যেন এই স্টোরিটা না করে।
ফারিহা মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলল, আপনার ধারণা আপনারা ঢাইলেই আমরা সাংবাদিকেরা সত্যি প্রকাশ করা বন্ধ রাখব? আপনি কি জানেন আমাদের দেশে বাচ্চাদের তাদের বাবা মায়েরা কী পরিমাণ যন্ত্রণার মাঝে রাখে? তাদেরকে কী পরিমাণ চাপ দেয়? কী রকম ভয়ংকর প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে রাখে? এটা তো শুধু একটা স্টোরি না—এরকম অনেক স্টোরি আমাদের কাছে আছে। আমরা একটা একটা করে প্রকাশ করব।
ফারিহা কথা বলছিল একটু ঢং করে, ভাবটা ছিল একটা ন্যাকা ন্যাকা। এর আগেও সে একবার ফোনে আকবর হোসেনের সাথে কথা বলেছিল, সে খুব সতর্ক যেন আকবর হোসেন গলার স্বর শুনে তাকে চিনে না ফেলে।
সুমনের ছোট বোনটি এতক্ষণ কোনো কথা না বলে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সবার কথা শুনছিল। এই প্রথম সে কথা বলার চেষ্টা করল, তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আব্ব, আমি একটা কথা বলি?
কী কথা?
তুমি ভাইয়াকে বল তার যেটা ইচ্ছা সে পড়তে পারবে। তুমি বল ভাইয়া যদি সায়েন্টিস্ট হয় তাহলে তুমি খুব খুশি হবে। তাহলেই এই সাংবাদিকেরা কিছু লিখবেন না। মেয়েটি ফারিহার দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না আপু?
ফারিহা বিভ্রান্ত হয়ে যাবার খুব চমৎকার একটা অভিনয় করল, তারপর বলল, হ্যাঁ, তাহলে এই কেসটা নিয়ে অবশ্যি লিখতে পারব না। কিন্তু আমাদের অন্য অনেক কেস আছে। সেগুলো নিয়ে লিখব।
মেয়েটা বলল, সেগুলো নিয়ে লিখেন, বেশি বেশি করে লিখেন। তারপর আবার তার আব্দুর দিকে তাকিয়ে বলল, চল আব্ব আমরা সবাই গিয়ে ভাইয়াকে নিয়ে আসি।
সুমনের আম্মু আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন। আকবর হোসেন গলা পরিষ্কার করে বললেন, আসলে কাজটা আমি বেকুবের মতোই করেছি। নিজের ছেলেকে বুঝতে পারি নাই এরকম একটা বাবা কেমন করে হলাম? চল সবাই মিলে যাই। গিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে আসি।
উত্তরার সাতাশ নম্বর বাসাটির (তেতাল্লিশ নয়!) ছয় তলায় একটা ছোট রুমে সুমন আর আরো দুজন ছেলে যখন ফ্লোরে খবরের কাগজ বিছিয়ে আলুভর্তা আর সেদ্ধ ডিম দিয়ে ভাত খাচ্ছিল ঠিক তখন আকবর হোসেন তার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। তাদেরকে দেখে সুমন প্রথমে চমকে উঠল, তারপর তার ছেলেমানুষী মুখটা হঠাৎ করে কঠিন হয়ে গেল।