ছোটাচ্চু চোখ পাকিয়ে বলল, খবরদার ফাজলামি করবি না। দেব একটা থাবড়া।
ছোটাচ্চু কখনো থাবড়া দেয় না, মেজাজ গরম করে না, তাই তাকে কেউ ভয় পায় না। সত্যি কথা বলতে কি, ছোটাচ্চুকে বাচ্চারা তাদের নিজেদের বয়সী মনে করে, তাই তাদের সব রকম ফুর্তি-ফার্তা, হাসি তামাশা সবকিছু ছোটাচ্চুকে নিয়ে। বাচ্চাকাচ্চাদের মধ্যে যে একটু বড়, সে বলল, তোমার গ্রেড কত, ছোটাচ্চু?
ছোটাচ্চুর চেহারাটা প্রথমে একটু কঠিন হলো, তারপর কেমন যেন দার্শনিকের মতো হলো, তারপর বলল, ইউনিভার্সিটির ডিগ্রিটা হচ্ছে বড় কথা। গ্রেড দিয়ে কী হবে? পাস করেছি, সেইটা হচ্ছে ইম্পরট্যান্ট।
ত্যাঁদড় টাইপের বাচ্চাটা বলল, তার মানে তোমার গ্রেড কুফা?
ছোটাচ্চু আবার চোখ পাকিয়ে বলল, মোটেও কুফা না।
তাহলে কত, বলো।
ছোটাচ্চু ঠিক করে দিল, টু পয়েন্ট থ্রি সিক্স।
বাচ্চাটা চোখ কপালে তুলে বলল, মাত্র টু?
টু পয়েন্ট থ্রি সিক্স।
একই কথা। তার মানে তুমি প্রায় ফেল করে গিয়েছিলে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছ।
ছোটাচ্চু বলল, মনে নেই, পরীক্ষার আগে আমার ডেঙ্গু হলো?
দাদি অবাক হয়ে বলল, তোর ডেঙ্গু হয়েছিল নাকি? কখন?
ওই যে জ্বর হলো। নিশ্চয়ই সেটা ডেঙ্গু ছিল।
বাচ্চাদের ভেতর ত্যাঁদড়জন জিজ্ঞেস করল, প্রাটিলেট কাউন্ট কত ছিল ছোটাচ্চু?
ব্লাড টেস্ট করাইনি।
তাহলে বুঝলে কেমন করে ডেঙ্গু?
ডেঙ্গু ছাড়া আর কী হবে? সবার তখন ডেঙ্গু হচ্ছিল, মনে নাই?
ত্যাঁদড়জন বলল, আসলে তোমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে তো সেই জন্য তুমি বানিয়ে বানিয়ে ডেঙ্গুর কথা বলছ।
সব বাচ্চাকাচ্চা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, একজন বলল, ছোটাচ্চু, তুমি তো লেখাপড়া করো নাই, সেই জন্য তোমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। তারা লেখাপড়া করে না, সে জন্য সব সময় বকুনি শুনতে হয়। এখন ছোটাচ্চুকে লেখাপড়া না করার জন্য ধরা যাচ্ছে, এ রকম সুযোগ খুব বেশি আসে না। তাই তারা সবাই সুযোগটার সদ্ব্যবহার শুরু করল, বলা শুরু করল:
প্রতিদিন নিয়ম করে পড়তে হয়। সকালে আর রাতে।
নো টিভি। টিভি দেখলে ব্রেন নষ্ট হয়ে যায়।
পড়ার সময় মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয়। উল্টাপাল্টা চিন্তা করলে হবে।
বই মুখস্থ করে ফেলবে। সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে, তুমি তো দশটার আগে ওঠো না।
আউল ফাউল বই পড়ে লাভ নেই। পাঠ্যবই ঝাড়া মুখস্থ, দাড়ি কমাসহ।
ছোটাচ্চু তখন সবাইকে একটা ধমক দিল, চুপ করবি তোরা? বেশি মাতবর হয়েছিস?
ত্যাঁদড় টাইপ বলল, তোমরা বললে দোষ নাই, আর আমরা বললে দোষ।
লাই দিতে দিতে মাথায় উঠে গেছিস।
একজনের জানার ইচ্ছে হচ্ছিল লাই জিনিসটা কী, সেটা কেমন করে দেওয়া হয়, সেটা কি হাত দিয়ে ধরা যায়, পকেটে রাখা যায়, কিন্তু ছোটাচ্চুর মেজাজ দেখে আর জিজ্ঞেস করার সাহস করল না।
দাদি বললেন, পাস করেছিস, এখন চাকরি-বাকরি করবি?
ত্যাঁদড় টাইপ বলল, ট পয়েন্ট থ্রি সিক্স দিয়ে কোনো চাকরি হবে না।
ছোটাচ্চু চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল, তারপর দার্শনিকের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি চাকরি করতে চাই না। চাকরি মানেই আরেকজনের গোলামি। স্বাধীনভাবে কাজ করব।
বড় ভাই পত্রিকা সরিয়ে মুখ বের করে বলল, আমরা যে চাকরি করি, সেটা কি গোলামি?
ছোটাচ্চু বলল, তোমার কথা আলাদা। তুমি বস। তোমার আন্ডারে যারা কাজ করে, তাদের কথা বলছি।
সব সময় নিচ থেকে শুরু করে ওপরে উঠতে হয়।
ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, নেভার। আমি ওপর থেকে শুরু করব।
ওপর থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে নিচে নামবি?
ছোটাচ্চু নার্ভাসভাবে হাসার চেষ্টা করল, বলল, না, ওপর থেকে শুরু করে ওপরেই থেকে যাব। একটা ফার্ম দেব।
বাচ্চাদের একজন জিজ্ঞেস করল, কিসের ফার্ম? মুরগির?
অন্য একজন বলল, হ্যাঁ। সব সময় মুরগির ফার্ম হয়। মুরগি ছাড়া আর কোনোকিছুর ফার্ম হয় না। মুরগি আর মোরগ। তার সাথে বেবি মোরগ।
আরেকজন শুদ্ধ করে দিল, তার সাথে ডিম। তাই না ছোটাচ্চু?
ছোটাচ্চু বলল, নেভার। আমি কেন মুরগির ফার্ম দেব?
তাহলে কিসের ফার্ম?
কোনো একধরনের সার্ভিস ফার্ম, যেখানে ইনভেস্টমেন্ট লাগে না।
বাচ্চাদের একজন জিজ্ঞেস করল, ইনভেস্টমেন্ট মানে কী?
ত্যাঁদড় টাইপ বুঝিয়ে দিল, টাকাপয়সা। ছোটাচ্চু কোনো টাকাপয়সা খরচ না করে টাকাপয়সা কামাই করবে। তাই না ছোটাচ্চু?
ছোটলোকের মতো শুধু টাকাপয়সা টাকাপয়সা করবি না। সার্ভিস ফার্ম খুব ইম্পরট্যান্ট কনসেপ্ট। সারা পৃথিবী এখন সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি দিয়ে চলছে। কত রকম সার্ভিস আছে দুনিয়াতে জানিস? আমাকে একটা খুঁজে বের করতে হবে।
সেটা কী সার্ভিস ছোটাচ্চু?
এখনো ঠিক করি নাই। বিষয়টা নিয়ে আগে গবেষণা করতে হবে। ছোটাচ্চু তখন মনে হয় তখন তখনই গবেষণা করতে বের হয়ে গেল। বড় ভাই পত্রিকাটা ভাজ করে পাশে রেখে দাদির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার এই ছেলের কপালে দুঃখ আছে।
দাদি কিছু বললেন না, উল দিয়ে সোয়েটার বুনতে লাগলেন।
বড় ভাই বলল, এ রকম লাফাংরা আর নিষ্কর্মা মানুষ আমি জন্মে দেখি নাই। বাবাও কাজের মানুষ ছিল, তুমিও কাজের মানুষ, তোমাদের ছেলে এই রকম নিষ্কর্মা হলো কেমন করে?
বাচ্চারা তখন একসাথে আপত্তি করল, না, বড় মামা। ছোটাচ্চু মোটেও নিষ্কর্মা না। যদিও বড় ভাই অনেকের বড় চাচা, আবার অনেকের বড় মামা। তার পরও সবাই তাকে বড় মামা বলে। নিজের ছেলেমেয়েরাও ভুলে মাঝেমধ্যে তাকে বড় মামা ডেকে ফেলে। একজন বলল, মনে নাই, আমরা যখন নাটক করেছিলাম তখন ছোটাচ্চু স্টেজ বানিয়ে দিয়েছিল।