- বইয়ের নামঃ টুনটুনি ও ছোটাচ্চু
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. বাসাটা তিনতলা
উৎসর্গ
কান পেতে রই-এর স্বেচ্ছাসেবকদের (তোমরা কিছু তরুণ তরুণী মিলে নিঃসঙ্গ, বিপর্যস্ত, হতাশাগ্রস্তদের মানসিক সেবা দেবার জন্যে একটি হেল্প লাইন খুলেছ। এমনকি আত্মহত্যা করতে উদ্যত কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে তোমাদের ফোন করেছিল বলে তোমরা তাদের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছ। আমি আমার সুদীর্ঘ জীবনে কখনো কারো জীবন বাঁচাতে পারিনি কিন্তু তোমরা এই বয়সেই মানুষের জীবন বাঁচাতে পার-কী আশ্চর্য!)
০১.
বাসাটা তিনতলা। কিংবা কে জানে, চারতলাও হতে পারে। আবার তিন কিংবা চারতলা না হয়ে সাড়ে তিনতলাও হতে পারে। এই বাসায় যারা থাকে, তাদের জন্য অসম্ভব কিছু না। এই বাসায় কারা থাকে, সেটা বলে দিতে পারলে মনে হয় ভালো হতো, কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া বলে লাভ কী, সবার নাম, বয়স, কে কী করে—এত সব কি আর মনে রাখা সম্ভব? শুধু একটা জিনিস বলে দেওয়া যায়, এই বাসার সবাই একই পরিবারের মানুষ। সংখ্যাটা শুধু আন্দাজ করা যেতে পারে, ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন হবে—কিংবা কে জানে, বেশিও হতে পারে। বাসাভর্তি বাচ্চা কিলবিল করছে। এতগুলো বাচ্চার হিসাব রাখা কঠিন, তাদের বাবা-মায়েরাই হিসাব রাখতে পারে না।
বাবা-মায়েরা যে হিসাব রাখতে পারে না তার অবশ্য একটা কারণ আছে। কারণটা হচ্ছে, তারা কে কখন কোথায় থাকে তার ঠিক নেই। হয়তো বাসায় খেতে বসেছে, ডাইনিং টেবিলে খাবারটা কারও পছন্দ হলো না, সাথে সাথে নাক কুঁচকে থালাটা বগলে নিয়ে ওপরে কিংবা পাশের ফ্ল্যাটে চলে যাবে। হয়তো স্কুলে যাওয়ার সময় হয়েছে স্কুলের পোশাক খুঁজে পাচ্ছে না, তখন তারা অন্যজনের ফ্ল্যাটে গিয়ে অন্য কারও পোশাক পরে ফেলবে। কাছাকাছি বয়স সমস্যা হয় না। বড়জোর একটু ঢলঢলে কিংবা একটু টাইট হয়, সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। রাতে ঘুমানোর সময় মায়েরা যদি দেখে বাচ্চা বিছানায় নেই, তাহলেও তারা দুশ্চিন্তা করে না। আবার যদি দেখে দুই-চারটা বাচ্চা বেশি, তাহলেও অবাক হয় না।
এই পরিবারের বাচ্চাকাচ্চা ছাড়া মাঝবয়সী মানুষও আছেন, আবার বুড়াে মানুষও আছেন। বুড়াে মানুষ অবশ্যি মাত্র একজন, তাঁর নাম জোবেদা খানম। জোবেদা খানমকে অবশ্য তার নাম দিয়ে ডাকার কেউ নেই, তাই জোবেদা খানমও তাঁর নিজের নামটা প্রায় ভুলেই গেছেন। বাচ্চাকাচ্চারা তাকে নানি না হয় দাদি ডাকে। কেউ যেন মনে না করে যাদের নানি ডাকার কথা তারা নানি ডাকে, আর যাদের দাদি ডাকার কথা তারা দাদি ডাকে! যখন যার যেটা ইচ্ছে, তখন তারা সেটা ডাকে। কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না, নানি কিংবা দাদি না ডেকে যদি খালা কিংবা আপু ডাকত, তাহলেও কেউ মনে হয় মাথা ঘামাত না।
জোবেদা খানমের বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে, সবাইকে নিয়ে একসাথে থাকেন। সব পরিবারের মেয়েদের বিয়ে হলে তারা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, এখানে কেউ যায়নি। ওপরতলা কিংবা নিচতলায় থেকে গেছে। সবারই বিয়ে হয়ে গেছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে, শুধু একজন ছাড়া। সে ঘোষণা দিয়েছে। যে সে বিয়ে করবে না। সেই ঘোষণা শোনার পর সবারই ধারণা হয়েছে, তার নিশ্চয়ই বিয়ে করার শখ হয়েছে। যাদের বিয়ে করার শখ হয়, তারা এ রকম ঘোষণা দেয়। একদিন সে বাসায় এসে বলল, গুড নিউজ।
সে প্রায় প্রত্যেকদিনই বাসায় এসে এ রকম কিছু একটা বলে, তাই কেউ তার কথার কোনো গুরুত্ব দিল না। দাদি চেয়ারে বসে সোয়েটার বুনতে থাকলেন, বাচ্চাকাচ্চারা ফোর টোয়েন্টি খেলতে থাকল, বড় ভাই পত্রিকা পড়তে থাকল আর ভাবি টেবিলে খাবার রাখতে থাকল।
তখন সে আবার গলা উঁচিয়ে বলল, গুড নিউজ। পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। আমি পাস করেছি।
বড় ভাই পত্রিকা থেকে চোখ না তুলে বলল, কী পরীক্ষা?
ছেলেটা বলল, মাস্টার্স।
বড় ভাই পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, বলল, মাস্টার্স? আমি ভেবেছিলাম তুই ইন্টারমিডিয়েটে পড়িস।
ছোট ভাই রাগ হয়ে বলল, ভাইয়া, তুমি কোনো কিছু খোঁজ রাখো না। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, সেইটা তুমি জানো না?
জানতাম মনে হয়, ভুলে গেছি।
ভাবি ডাইনিং টেবিলে শব্দ করে একটা প্লেট রেখে বলল, সব সময় এক কথা, ভুলে গেছি। জিজ্ঞেস করে দেখো তার কয়টা ছেলেমেয়ে, সেটা মনে আছে কি না। সেটাও মনে হয় ভুলে গেছে।
বড় ভাই তখন আবার পত্রিকায় মুখ ঢেকে ফেলল, একবার এটা নিয়ে আলোচনা শুরু হলে সব সময় সে বিপদে পড়ে যায়।
মেঝেতে বসে যে বাচ্চাকাচ্চা ফোর টোয়েন্টি খেলছিল তাদের একজন জিজ্ঞেস করল, ছোটাচ্চু, তুমি কি গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছ?
তার আসল নাম শাহরিয়ার কিন্তু বাচ্চারা কেউ সেটা জানে বলে মনে হয় না। চাচাদের মধ্যে সে ছোট, তাই তাকে ছোট চাচা ডাকা হয়। যাদের সে ছোট মামা তারাও তাকে ছোট চাচা ডাকে। ছোট চাচা শব্দটা ছোট হতে হতে ছোটাচ্চু হয়েছে, আরও ছোট হবে কি না কেউ জানে না।
ছোটাচ্চু বলল, ইউনিভার্সিটিতে গোল্ডেন ফাইভ হয় না।
তাহলে কী হয়?
বাচ্চাদের মধ্যে যে একটু ত্যাঁদড় টাইপের সে বলল, প্লস্টিক ফাইভ!
সব বাচ্চা তখন হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগল, পাস্টিক ফাইভ, প্লাস্টিক ফাইভ!