ফারিহাপু বলল, “শোনো, তোমাদের একটা কথা বলি। ভবিষ্যতে যদি কখনো অন্য কাউকে এরকম কিছু করতে হয়, খবরদার ব্লাড ক্যান্সারের কথা বলবে না।” ফারিহাপুর মুখটা হঠাৎ কেমন যেন দুঃখী দুঃখী দেখাতে থাকে, মনে হয় বুঝি কেঁদে ফেলবে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল, তারপর প্রায় ভাঙা গলায় বলল, “তোমরা চিন্তাও করতে পারবে না গত চব্বিশ ঘণ্টা আমার কী গিয়েছে” ফরিহাপু আবার ঠোঁট কৃার্মড়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে থাকে।
প্রথমে টুনি ছুটে গিয়ে ফাৱিহাপুর সামনে গিয়ে বসে তার হাত দুটো ধরে ফেলল, তারপর ফিসফিস করে বলল, “আমার খুব খারাপ লাগছে ফারিহাপু, আমরা তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছি–প্লিজ ফারিহাপু তুমি মন খারাপ কোরো না, তুমি আমাদের উপর রাগ হয়ো না–আমরা বুঝতে পারছিলাম না কী করব–
টুনির দেখাদেখি অন্য সবাই তখন ফারিহাপুর কাছে গিয়ে তাকে ঘিরে বসে ধরে বলল, “প্লিজ ফারিহাপু প্লিজ”
আর তখন ফারিহাপু বাচ্চাদের মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল, আর তাকে কাঁদতে দেখে অন্যরাও কাঁদতে শুরু করল।
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ এই দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর কেশে গলা একটু পরিষ্কার করে বলল, “ইয়ে মানে, ব্লাড ক্যান্সারের কথাটা বলেছে আমাকে নিয়ে–কান্দাকাটি যদি করতে হয় তাহলে আমাকে ধরে কান্দাকাটি করবি, ফারিহাপুকে ধরে কাঁদছিস কেন?”
প্রমি বলল, “তুমি যদি এটা বুঝতে তাহলে এই অবস্থা হতো না। সব দোষ তোমার।”
“আমার?”
“হ্যাঁ।” টুম্পা বলল, “নিশ্চয়ই তোমার বুকে লোম নাই। নিষ্ঠুর মানুষের বুকে লোম থাকে না।”
“তোর বুকে লোম আছে ফাজিল কোথাকার?”
“আমি ছোট। তা ছাড়া আমি মেয়ে। বুঝেছ?”
যখন সবাই কান্নাকাটি থামিয়ে চোখ-নাক-মুখ মুছে একটু শান্ত হলো তখন ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে অনেক হয়েছে–এখন তাহলে পুতুলের বিয়ে শুরু হোক।”
তখন সব বাচ্চারা একে অন্যের দিকে তাকাল, কেউ কোনো কথা বলল না। ছোটাচ্চু বলল, “কী হলো? পুতুলের বিয়েটাও কি মিছিমিছি? ষড়যন্ত্রের অংশ?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “এটা একটুখীনি ষড়যন্ত্রের অংশ হলেও পুতুলের বিয়েটা মিছিমিছি ছিল না। এটা সত্যিকারের বিয়ে ছিল। কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
আবার সবাই থেমে গেল, একে অন্যকে গুঁতো দিয়ে বলতে লাগল, “তুই বল–তুই বল–”
ছোটাচ্চু বলল, “কী হলো? বলবি কী হয়েছে?”
শেষ পর্যন্ত টুনি গলা পরিষ্কার করে আবার বলতে শুরু করল, “আসলে হয়েছে কী–যখন রিংকুর ছেলে বরযাত্রী হয়ে এসেছে তখন সবাই মিলে আমরা গেট ধরেছি। তখন বরযাত্রীর পক্ষ থেকে শান্ত বলেছে, যৌতুক না দিলে সে বিয়ে দেবে না।”
ছোটাচ্চু বলল, “ছেলের মা হচ্ছে রিংকু তাহলে শান্ত কেন যৌতুক চায়? এটা তো রীতিমতো সন্ত্রাসী কাজকর্ম।”
টুনি বলল, “তুমি ঠিক বলেছ ছোটাচ্চু। শান্ত ভাইয়া আসলে সন্ত্রাসী লাইনেই যাচ্ছে। আমরা তাকে বলেছি যৌতুক হচ্ছে বেআইনি। যৌতুক চাইলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে-কিন্তু শান্ত ভাইয়া বলল যৌতুক না দিলে সে বিয়ে হতে দিবে না। তাই শেষ পর্যন্ত আমরা যৌতুক দিতে রাজি হলাম”
ফারিহাপু বলল, “কী সর্বনাশ! যৌতুক কী দিতে হবে?”
শান্ত অপরাধীর মতো মুখ করে বলল, “বেশি কিছু না ফারিহাপু, মাত্র একশ’ টাকা।”
“তাও রক্ষা।”
টুনি বলল, “পুতুলের বিয়ে, সবকিছুই মিছিমিছি তাই আমরা ভেবেছি টাকাটাও মিছিমিছি। তাই কাগজ কেটে আমরা মিছিমিছি একশ’ টাকার নোট বানিয়ে শান্ত ভাইয়াকে দিয়েছি, তখন শান্ত ভাইয়া বলল, মিছিমিছি একশ টাকা দিলে হবে না, সত্যি সত্যি একশ’ টাকা দিতে হবে–”
ছোটাচ্চু আর ফারিহাপু চোখ কপালে তুলে বলল, “সত্যি সত্যি একশ’ টাকা! কী সর্বনাশ!”
শান্ত বলল, “এত বড় বিয়ে, কোনো খরচপাতি হবে না এটা ঠিক না। সেই জন্যে”
টুনি বলল, “আমরা রাজি হই নাই। তখন শান্ত ভাইয়া পুতুলটা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল–আমরাও ধরেছি যেন নিতে না পারে। তখন—” টুনি আবার থেমে গেল।
“তখন কী?”
“তখন পুতুলের মাথাটা ছিঁড়ে আলগা হয়ে গেল। মাথাটা শান্ত ভাইয়ের কাছে, শরীরটা আমাদের কাছে!”
“এখন কী হবে?”
“বিয়েটা পিছিয়ে দিতে হবে।” রিংকু মুখ গম্ভীর করে বলল, “শান্ত ভাইয়া মাথাটা ফিরিয়ে দিলে আমার ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করব। মাথাটা সেলাই করে লাগানো হবে।”
ফারিহাপু জানতে চাইল, “হাসপাতালের সার্জন কে?”
“ঝুমু খালা। ঝুমু খালা এক নম্বর সার্জন।”
“সেলাই করে লাগাতে পারবে?”
“পারবে।”
ছোটাচ্চু গম্ভীর মুখে শান্তর দিকে তাকাল, “শান্ত।”
“বলো ছোটাছু।”
“এক্ষুনি রিংকুর ছেলের মাথা ফিরিয়ে দে। যদি কোনোদিন যৌতুক চাস তাহলে তোর খবর আছে।”
শান্ত পকেট থেকে পুতুলের মাথাটা বের করে রিংকুর হাতে দিয়ে বলল, “আসলে আমি ঠাট্টা করছিলাম! এরা ঠাট্টাও বুঝে না।”
ছোটাচ্চু বলল, “এরপর আর এরকম ঠাট্টাও করা যাবে না। মনে থাকবে?”
“থাকবে।”
ফারিহাপু বলল, “তাহলে এখন কি সব শেষ?”
প্রমি বলল, “না শেষ না। এখন খাওয়া-দাওয়া হবে।”
“মিছিমিছি নাকি সত্যি সত্যি?”
“সত্যি সত্যি। ঝুমু খালা খাবার তৈরি করেছে।”
ছোটাচ্চু দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “এই ঝুমু খালা কেমন করে এই বাসায় থাকে আমি দেখব। কী ডেঞ্জারাস মেয়ে–আমার ঠ্যাঙ ভেঙে ফেলার বুদ্ধি দেয়!”
ফারিহাপু হি হি করে হেসে বলল, “উদ্দেশ্যটা মহৎ! মহৎ উদ্দেশে কাজ করলে কোনো সমস্যা নাই।”