মিনিট দশেক সবাই ড্রাইভারের বকবকানি সহ্য করল, তারপর ঝুমু খালা ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, “ড্রাইভার সাহেব।”
“বলেন।”
“আমার ব্যাগে একটা গামছা আছে।”
ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, “গামছা?”
“হ্যাঁ। যদি আপনি আর একটা কথা বলেন এই গামছা দিয়ে আপনার মুখটা বেনধে দিক বুঝেছেন?”
ড্রাইভার অবাক হয়ে ঝুমু খালার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “আপনে কথাবার্তা পছন্দ করেন না?”
“করি। কিন্তু–”
“মানুষ ছাড়া আর কোনো পশু-পাখি, জন্তু-জানোয়ারের জবান আছে? নাই। এখন মানুষ যদি জবান ব্যবহার না করে, কথা না বলে তাহলে মানুষে আর জানোয়ারে কোনো পার্থক্য আছে? নাই।”
ঝুমু খালা বলল, “আপনি বিয়া করছেন? বউ আছে?”
ড্রাইভার থতমত খেয়ে বলল, “আছে। বউ আছে। বিয়া করেছি।”
“কয় নম্বর বউ?”
ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে বলল, “কয় নম্বর বউ মানে?”
“মানে আপনার এক নম্বর বউ, নাকি দুই নম্বর বউ, নাকি তিন নম্বর?”
ড্রাইভার মুখ শক্ত করে বলল, “আপনি কেন এটা জিজ্ঞাসা করছেন?”
ঝুমু খালা বলল, “আপনি যত বেশি কথা বলেন আপনার কোনো বউ ছয় মাসের বেশি লাস্টিং করার কথা না। বড়জোর এক বছর।
ড্রাইভার কোনো কথা বলল না। ঝুমু খালা বলল, “কী হলো কথা বলেন না কেন? কত নম্বর বউ?”
ড্রাইভার এবারেও কোনো কথা বলল না, শুধু নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা শব্দ করল। ঝুমু খালা ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না, মাথাটা ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকিয়ে বলল, “শরমের কী আছে? বলে ফেলেন!”
ড্রাইভার বলল, “আপনার মুখ খুব খারাপ। বড় বাজে কথা বলেন।”
ঝুমু খালা শব্দ করে হাসল, বলল, “সত্যি কথা বললে মুখ খারাপ হয়? ঠিক আছে আপনার কিছু বলতে হবে না। যা বোঝার আমরা সেটা বুঝে নিয়েছি। তয় ড্রাইভার সাহেব, আপনারে একটু উপদেশ দেই, যদি বউরে লাস্টিং করাতে চান, কথা কম বলবেন।”
ড্রাইভার সেই যে মুখ বন্ধ করল আর কথা বলল না। পিছনে বসে ছোটাচ্চু থেকে শুরু করে টুম্মা পর্যন্ত সবাই ঝুমু খালার ধারালো জিবটাকে মনে মনে স্যালুট দিল।
শহরের ভিড়, ট্রাফিক জ্যাম পার হয়ে যখন মাইক্রোবাসটা একটু ফাঁকা রাস্তায় উঠে গেল তখন সবাই ড্রাইভারের দ্বিতীয় এবং আসল গুণটার খবর পেল। তারা আবিষ্কার করল ড্রাইভার গুলির মতো মাইক্রোবাসটাকে রাস্তা দিয়ে প্রায় উড়িয়ে নিতে শুরু করেছে। এরকম বিপজ্জনকভাবে যে গাড়ি চালানো যায় তারা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারে না। (বিপরীত দিক থেকে একটা ভয়ঙ্কর ট্রাক ছুটে আসছিল, মাইক্রোবাসের ড্রাইভার তার মাঝে রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা বাসকে ওভারটেক করে সেই ভয়ঙ্কর ট্রাকের একেবারে গায়ে ঘষা দিয়ে বের হয়ে গেল। ছোটাচ্চু প্রায় চিৎকার করে বলল, “সর্বনাশ।”
ড্রাইভার ছোটাচ্চুর চিৎকার শুনল বলে মনে হলো না, দৈত্যের মতো ছুটে আসা আরেকটা ট্রাকের দিকে মুখোমুখি ছুটে যেতে যেতে একেবারে শেষ মুহূর্তে কোনোভাবে পাশ কাটিয়ে গেল। ট্রাক ড্রাইভার পর্যন্ত চমকে উঠে বিকট সুরে হর্ন বাজাতে থাকল। ছোটাচ্চু আবার চিৎকার করে বলল, “ড্রাইভার সাহেব! সাবধান!”
‘ড্রাইভার সাহেব কোনো কথা বলল না, ছোটাচ্চুর কথা শুনেছে সেরকম ভাবও দেখাল না। ঠিক যেভাবে মাইক্রোবাস চালাচ্ছিল সেভাবে চালিয়ে যেতে থাকল, মনে হলো হঠাৎ করে স্পিড আরো বাড়িয়ে দিল। ছোটাচ্চু গলা উঁচিয়ে বলল, “ড্রাইভার সাহেব!”
ড্রাইভার মাথা ঘুরিয়ে বলল, “কী হইছে?”
“এইভাবে ড্রাইভ করছেন কেন? একটু সাবধানে চালান।”
ড্রাইভার আবার সামনে তাকিয়ে বলল, “কেন?”
“যে কোনো সময়ে একসিডেন্ট হবে!”
“একসিডেন্ট কি হয়েছে?”
“হয় নাই কিন্তু তার মানে এই না যে হতে পারে না। আপনি আস্তে চালান, সাবধানে চালান।”
ড্রাইভার মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “কোনো ভয় নাই। একসিডেন্ট হবে না। নিশ্চিত থাকেন।“
“আপনি যেভাবে চালাচ্ছেন যে কোনো সময়ে একসিডেন্ট হতে পারে।”
ড্রাইভার মাথা নাড়ল, বলল, “আমি যেভাবেই চালাই কিছু আসে যায় না। কোনোদিন একসিডেন্ট হবে না।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“এই গাড়ির উপরে দোয়া আছে।”
“দোয়া?”
“জে।”
“সেটা কী রকম?”
ড্রাইভার মুখ গম্ভীর করে বলল, “চাক্কা পীরের নাম শুনেছেন?”
“চাক্কা পীর?”
“জে। চাক্কা পীর। চাক্কার উপরে চলে যত জিনিস তার সবকিছুর জন্যে এই পীরের তাবিজ আছে। একবারে জিন্দা তাবিজ। কোনো গাড়িতে যদি এই তাবিজ থাকে সেই গাড়ির কোনোদিন একসিডেন্ট হয় না।”
“আপনার গাড়িতে এই তাবিজ আছে?”
“জে।”
“কোথায়?”
ড্রাইভার হাত দিয়ে দেখাল, রিয়ার ভিউ মিরর থেকে বড়সড় একটা তাবিজ ঝুলছে। “মনে করেন আমি এখন আমার এই গাড়ি দিয়ে যদি সামনের ট্রাকের সাথে একসিডেন্ট করার চেষ্টা করি, এই গাড়ির কিছু হবে না–ঐ ট্রাক রাস্তা থেকে নিচে পড়ে যাবে।”
ছোটাচ্চু নিজে গলায় এত বড় একটা তাবিজ নিয়ে রওনা দিয়েছে এখন তাবিজের ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ করে কেমন করে? তাই খালি দুর্বল গলায় বলল, “ট্রাকের সাথে লাগানোর চেষ্টা করবেন না প্লিজ!”
ড্রাইভার বলল, “কী বলেন স্যার! ঐ ট্রাকের ড্রাইভার-হেল্পারের জীবনের দাম আছে না?”
একটা বাসকে অসম্ভব বিপজ্জনকভাবে ওভারটেক করে সামনের দিক থেকে আসা আরেকটা বাসের একেব্বরে গা ঘেঁষে পাশ কাটিয়ে মাইক্রোবাসটা রাস্তার মাঝখানে একটা গর্তের উপর দিয়ে প্রায় লাফিয়ে পার হয়ে গেল। মাইক্রোবাসের ভেতরে সবাই একবার ডান দিকে আরেকবার বাম দিকে গড়িয়ে পড়তে লাগল। ছোটাচ্চু দুর্বলভাবে বলল, “আস্তে ড্রাইভার সাহেব! একটু আস্তে!”