টুনি বলল, “আমি বলছিলাম মুনিয়াকে দাবা খেলাটা শিখিয়ে দেই।”
হঠাৎ করে মিশু বলল, “আমি একটা কথা বলি?”
সবাই থেমে গেল, মিশুর দিকে তাকিয়ে তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। মিশু বলল, “তোমরা সবাই বলছ লুডো খেলার মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই। কিন্তু আমার মনে হয় আছে।”
শান্ত বলল, “আছে? যার ছক্কা বেশি পড়ে সে জিতে-এর মাঝে বুদ্ধিটা কোনখানে?”
মিশু হাসি হাসি মুখ করে বলল, “হ্যাঁ আছে। এর মাঝেও বুদ্ধি আছে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে তোমরা একটা লুডো টুর্নামেন্ট করো, আমিও সেখানে খেলি।”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তুমি খেলে চ্যাম্পিয়ন হবে?”
মিশু হাসি হাসি মুখে বলল, “যদি চাই তাহলে হতে পারি।”
শান্ত চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তার মানে তুমি আমাদের সবাইকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছ?”
মিশু বলল, “আমি ঠিক চ্যালেঞ্জ শব্দটা ব্যবহার করতে চাই না কিন্তু বলা যায় তোমরা কোনোভাবে মনে হয় আমাকে হারাতে পারবে না।”
“সত্যি?”
মিশু মাথা নাড়ল, প্রমি বলল, “দেখা যাক।”
শান্ত বলল, “ফ্যান্টাস্টিক আইডিয়া। ছোটাচ্চুকে বলি স্পন্সর করতে। টুর্নামেন্টের নাম হবে ‘ছোটাচ্চু লুডো টুর্নামেন্ট। এন্ট্রি ফি পঞ্চাশ টাকা। আমি হব ইভেন্ট ম্যানেজার আর রেফারি। দাদি হবে চিফ এডভাইজার। ফাটাফাটি ইভেন্ট!”
মুনিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কিন্তু আমার সাথে কে খেলবে?”
কেউ তার কথার উত্তর দিল না। সবাই তখন লুডো টুর্নামেন্ট নিয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলতে শুরু করেছে।
.
শান্তর ঘরে মিশুর থাকার জায়গা করে দেয়া হলো। মিশু তার ব্যাক প্যাক থেকে বইপত্র বের করে বিছানায় রাখে। শান্ত বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিল, সাইকোলজির একটা বই ধরতেই শান্ত বইটা তার হাত থেকে নিয়ে নিল, বলল, “এই বইটা তুমি দেখতে পারবে না।”
“কেন?”
“এটা দিয়ে আমি ম্যাজিক দেখাই। এটা আমার ম্যাজিক বই।”
“ম্যাজিক বই?”
“হ্যাঁ।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কী রকম ম্যাজিক বই?”
“এই দেখো–” বলে মিশু বইটা খুলে পৃষ্ঠা উল্টে দেখাল। শান্ত কোনো ম্যাজিক দেখল না। খুবই সাধারণ একটা বই, ভুরু কুঁচকে বলল, “কোথায় ম্যাজিক?”
“এই দেখো।” বলে শান্ত বইটার উপর আঙুল দিয়ে একটা ক্রস চিহ্ন দিল। তারপর বইটা খুলতেই দেখে প্রত্যেক পৃষ্ঠায় একটা ক্রস আঁকা।
শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, “কী আশ্চর্য!”
মিশু জিজ্ঞেস করল, “কোনটা তোমার কাছে আশ্চর্য লেগেছে?”
“এক্ষুনি বইটাতে কিছু ছিল না এখন প্রতি পৃষ্ঠায় ক্রস।”
মিশু বলল, “ক্রস? কোথায় ক্রস?” বলে সে বইটা আবার খুলে দেখায়, প্রতিটি পৃষ্ঠা আগের মতো, কোনো ক্রস নেই? শান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, বলল, “আমাকে শেখাবে কেমন করে এই ম্যাজিকটা দেখাও।”
মিশু বলল, “সবাইকে সবকিছু শেখানো যায় না। কোনো কিছু ভালো করে শিখতে হলে তার জন্যে পরিশ্রম করতে হয়।”
.
হাত-মুখ ধুয়ে মিশুকে নিয়ে শান্ত নিচে নাস্তা খেতে এলো। ঝুমু খালা টেবিলে গরম গরম ডালপুরী আর চা দিয়েছে। সবাই ঝুমু খালার বিখ্যাত ডালপুরীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চা অবশ্যি সবার কপালে জুটে না–এই বাসায় একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত চা খাবার পারমিশন পাওয়া যায় না। ঝুমু খালার মন ভালো থাকলে মাঝে মাঝে এক-দুইজনকে বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে আধা কাপ চা তৈরি করে দেয়।
আজকে ঝুমু খালার মন নিশ্চয়ই ভালো ছিল তাই টুম্পাকে আধ কাপ চা দিয়েছে। টুম্পা খুবই গম্ভীর ভঙ্গিতে সেই চা খাচ্ছে, তখন মিশু টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার চায়ে একটু ম্যাজিক করে দিই?”
টুম্পা অবাক হয়ে বলল, “ম্যাজিক?”
“হ্যাঁ।”
শান্ত তখন চোখ বড় বড় করে হাত-পা নেড়ে নেড়ে বলল, “ও, তোরা কেউ জানিস না, মিশু ভাই আস্ত ম্যাজিশিয়ান। একেবারে জুয়েল আইচ!”
সবাই মিশুর দিকে ঘুরে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”
মিশু কিছু বলল না, শান্ত জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “সত্যি মানে সত্যি! ডাবল সত্যি। একটু আগে বইয়ের উপরে আঙুল দিয়ে দাগ দিয়ে বইয়ের ভিতর ক্রস এঁকে ফেলেছে।”
টুম্পা বলল, “আমাদের দেখাবে?”
মিশু বলল, “অন্য সময় দেখাব। এখন বরং তোমাকে চায়ের ম্যাজিক দেখাই।”
“দেখাও।”
মিশু বলল, “ঠোঁটগুলো যতটুকু পারো ভেতরে নাও, তারপর চা খাও, দেখবে কী ম্যাজিক হবে! যত বেশি মুখের ভেতর নিতে পারবে তত বড় ম্যাজিক।”
সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল। টুম্পা তার ঠোঁট দুটো মুখের ভেতরে নিয়ে তার চায়ে চুমুক দিতে গিয়েই চিৎকার করে চায়ের কাপ ফেলে দিয়ে দুই হাতে মুখ চেপে প্রায় কাঁদতে শুরু করে দিল।
সবাই ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
টুম্পা হাত দিয়ে তার মুখটা ঢেকে রেখেছে। মিশু হা হা করে হেসে বলল, “কী আর হবে? কিছু হয় নাই! মুখে গরম চায়ের একটু ছ্যাঁকা খেয়েছে। মানুষের ঠোঁট গরম সহ্য করতে পারে, অন্য জায়গা পারে না, সেটাই দেখানো হলো!”
মিশুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার দিকে কেউ নজর দিল না, টুনি টুম্পাকে হাত ধরে রান্নাঘরে নিয়ে গেল, ফ্রিজ থেকে এক টুকরো বরফ বের করে তার ঠোঁটে লাগিয়ে দিল যন্ত্রণাটা কমানোর জন্যে। মিশু তখনো দুলে দুলে হাসছে। ঝুমু খালা কোমরে হাত দিয়ে মিশুর দিকে তাকিয়ে মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি মানুষটা তো ভালো না, ছোট বাচ্চাদের কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাও!”