ছোটাচ্চুর ঘরের দরজা খুলে টুনি ভিতরে ঢুকে ছোটাচ্চুর বিছানায় বসে বলল, “বলো ছোটাচ্চু, তুমি আমাকে আসলে কী বলতে চাইছিলে এখন বলো।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “তুই কেমন করে বুঝলি?”
“না বোঝার কী আছে? তুমি এখনও মিথ্যা কথা বলা শিখো নাই। তুমি যখন মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করো তোমার নাকটা একটু মোটা হয়ে যায়, ঠোঁট কাঁপে আর বাম চোখটা ছোট হয়ে যায়।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “না-না-নাক মোটা হয়ে যায়?”
টুনি বলল, “এখন সেগুলো চিন্তা করে লাভ নাই ছোটাচ্চু, যেটা বলতে চাও সেটা বলে ফেলো। একটু পরে অন্যেরা চলে আসবে। অন্য সবাই চলে আসলে তুমি তোমার কথা থামিয়ে দিও। তখন আমি ফারিয়াপুর প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলব, আসলে কী নিয়ে কথা হচ্ছে কেউ টের পাবে না।”
ছোটাচ্চু আরো কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা চুলকাল, তারপর বগল চুলকাল, তারপর গলা পরিষ্কার করে তাকে একটা কাহিনি বলল। কাহিনিটা এ রকম :
ছোটাচ্চু তার অফিসে বসে কাজ করছে তখন তাদের অফিসের সেক্রেটারি রঞ্জনা এসে জানাল একজন মহিলা তার সাথে দেখা করতে এসেছে। ছোটাচ্চু বলল, মহিলাকে পাঠিয়ে দিতে।
একটু পরেই মহিলা ছোটাচ্চুর অফিসে ঢুকল, মোটাসোটা নাদুসনুদুস মহিলা। ফর্সা, ঠোঁটে লিপস্টিক, বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের ভেতর। সব সময় ভুরু কুঁচকে থাকতে থাকতে ভুরুর উপর পাকাপাকিভাবে ভাঁজ হয়ে গেছে। দেখেই মনে হয় দুনিয়ার সবার উপরে খুবই বিরক্ত।
ছোটাচ্চু মহিলাকে তার সামনের চেয়ারে বসতে দিয়ে বলল, “বলেন ম্যাডাম আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি?”
মহিলা খুবই সন্দেহের চোখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আপনি ডিটেকটিভ?”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি একা না, আমাদের একটা বড় টিম আছে।”
“আপনার বয়স এত কম, আপনি কী করবেন?”
ছোটাচ্চু বিরক্তি চেপে বলল, “বয়সটা তো ইস্যু না। আপনার সমস্যার সমাধান করতে পারি কি না সেটা হচ্ছে ইস্যু! আমরা একটা রেজিস্টার্ড প্রফেশনাল অর্গানাইজেশন, আপনার যদি আমাদের পছন্দ না হয় আপনি আমাদের কাছে আসবেন না, অন্য কোথাও যাবেন!”
“আর তো কেউ নাই আপনারা ছাড়া।”
ছোটাচ্চু জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে বলল, “তা ছাড়া আমরা যে সব কেস নিই তাও তো নয়। পছন্দ না হলে আমরা কেস নিই না।”
মহিলা তার কুঁচকানো ভুরু আরো কুঁচকে বলল, “আমার কেসটা আপনারা নিবেন না?”
ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না, আমি সেটা বলিনি। আমি তো আপনার কেসটা এখনও জানিই না। বলেন আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি।”
মহিলা ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনারা আমার মেয়েটাকে বাঁচান।”
“কী হয়েছে আপনার মেয়ের?”
মহিলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমি জানি না। মনে হয় ড্রাগস!”
ছোটাচ্চু আঁতকে উঠল, বলল, “ড্রাগস! কত বড় মেয়ে আপনার?”
“ক্লাস সেভেনে পড়ে। তেরোতে পা দিয়েছে।”
“এত ছোট মেয়ে ড্রাগস ধরেছে?”
“ধরেছে কি না জানি না, আমি সন্দেহ করছি।”
ছোটাচ্চু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “আপনি কেন সন্দেহ করছেন?”
“ড্রাগ এডিক্টের মতো ব্যবহার করে।”
“সেটা কী রকম?”
“কথা বলে না। একা একা থাকে। শুকিয়ে যাচ্ছে, কোনো কিছুতে মনোযোগ নেই। পড়ালেখা করতে চায় না। গত পরীক্ষায় গোল্ডেন ফাইভ হয় নাই।”
“গোল্ডেন ফাইভ?”
“হ্যাঁ”, মহিলা এবারে ফাঁসফাস করে কাঁদতে শুরু করল, বলল, “আপনি চিন্তা করতে পারেন, আমার মেয়ের পিছনে আমি এত সময় দেই আর সেই মেয়ের গোল্ডেন ফাইভ হয় না? তার জন্যে কতগুলো প্রাইভেট টিচার আর কোচিং রেখেছি আপনি শুনতে চান?”
ছোটাচ্চু ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল, মহিলা তখন বলতে শুরু করল, “সকালে ফৌজিয়া ম্যাডাম, দুপুরে তালুকদার স্যার, তারপর প্যারাগন কোচিং, রাত্রে বিল্লাহ স্যার–”
ছোটাচ্চু ভয়ে ভয়ে বলল, “ক্লাস সেভেনের একটা মেয়ের জন্যে এইটা একটু বেশি হয়ে গেল না?”
“বেশি?” মহিলা বেশ অবাক হলো, বলল, “অন্যরা কী করে শুনবেন?”
ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না, শুনতে চাই না।”
মহিলা বলল, “মেয়েটার গানের গলা ভালো, সেই জন্যে আমি গানের স্কুলে নেই, অন্যরা তো তাও নেয় না, তাদের সবকিছু বন্ধ। মেয়েটা এখন গানও গাইতে চায় না। আমি ভেবেছিলাম টেলিভিশনে গানের কম্পিটিশনে দিব কিন্তু যদি প্র্যাকটিস না করে কেমন করে কম্পিটিশন করবে?”
ছোটাচ্চু চুপচাপ বসে রইল আর মহিলা টানা কথা বলে গেল। যখন দম নেবার জন্যে একটু থেমেছে তখন ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আমাকে ঠিক কী করতে হবে?”
“খোঁজ নিয়ে বের করবেন মেয়েটা আসলেই ড্রাগ নেয় কি না। নিলে কী ড্রাগ নেয় আর কার কাছ থেকে সেই ড্রাগ কিনে।”
ছোটাচ্চু মহিলার কথাবার্তা শুনে প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিল এই মহিলার কেসটা নিবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিতে রাজি হলো। ক্লাস সেভেনের একটা মেয়ে সত্যিই যদি ড্রাগ নেয়া শুরু করে তাহলে তাকে তো সাহায্য করা দরকার। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনার মেয়ের নাম কী?”
“আইরিন। ভালো নাম মাহজাবিন বিনতে কায়েস।”
“মেয়ের ছবি আছে আপনার সাথে?”
“হ্যাঁ, নিয়ে এসেছি।” বলে ব্যাগ থেকে কয়েকটা ছবি বের করে ছোটাচ্চুর হাতে দিল। ছোটাচ্চু ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখল, ছবিতে ড্রাগ এডিক্ট হওয়ার কোনো চিহ্ন নেই। হাসি-খুশি একটা মেয়ে। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনার হাজব্যান্ড কী করেন?”