মিনিট দশেক পর টুনি টুম্পাকে সিগন্যাল দিল তখন টুম্পা নিজের ঘরে গিয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, “ঝুমু খালা ও ঝুমু খালা–”
ঝুমু খালা এবং আরো কয়েকজন টুম্পার ঘরে ছুটে গেল। টুম্পা মেঝেতে বসে তার পা ধরে চিৎকার করছে। ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“আমার পায়ের রগে আবার টান পড়েছে।”
ঝুমু খালা বসে টুম্পার পা ধরে আঙুলগুলো টানতে টানতে বলল, “তুমি কী করছ?”
“কিছু করি নাই–শুধু চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে ঐ পর্দাটা সরাতে যাচ্ছিলাম–” টুম্পা পুরোপুরি অর্থহীন কথা বলতে থাকে, কথাগুলো যে অর্থহীন সেটাও কেউ বুঝতে পারল না!
ঠিক এই সময়ে টুনি বড় ফ্লাস্কের সব গরম পানি ঢেলে সেখানে ট্যাপের পানি ভরে রাখে। তারপর টুম্পার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে টুম্পা?”
টুম্পা বলল, “পায়ের রগে টান পড়েছে।”
টুনি টুম্পার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিতেই টুম্পা বলল, “মনে হয় রগটা একটু ঢিলা হয়েছে, ব্যথা কমেছে।”
ঝুমু খালা বিশাল একটা লেকচার দিতে শুরু করে, টুম্পা পুরোটুকু ধৈর্য ধরে শুনে!
মিনিট দশেক পর টুনি রান্নাঘরে গিয়ে ঝুমু খালাকে একটা বাটি দিয়ে বলল, “ঝুমু খালা, এই বাটিতে গরম পানি দাও।”
ঝুমু খালা গরম কড়াইয়ে কিছু সবজি ছেড়ে দিয়ে টুনির বাটিটা হাতে নিয়ে ফ্লাস্ক থেকে পানি ঢেলে দিল। পানিটা দেখেই তার কেমন সন্দেহ হয়, হাত দিয়ে দেখে পানিটা মোটেও গরম নয়–একেবারে ঠান্ডা!
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ঝুমু খালা?”
“পানি ঠান্ডা হয়ে গেছে!”
“ঠান্ডা হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ”
“কেন?”
ঝুমু খালা ফ্লাস্কটা খুলে ভিতরে উঁকি দিয়ে বলল, “মনে হয় এইটা নষ্ট হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই চায়নিজ মাল। চায়নিজ মাল দুই দিনে নষ্ট হয়ে যায়। কত তাড়াতাড়ি পানি ঠান্ডা হয়ে গেল।”
টুনি বলল, “আবার একটু গরম পানি দিয়ে দেখবে?” ঝুমু খালা বলল, “ঠিক আছে দেখি।”
এইবার টুম্পার ব্যাক পেকের জিপার আটকে গেল। সেই জিপার খুলে দেয়ার জন্যে টুম্পা তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, “ঝুমু খালা ও ঝুমু খালা–”
ঝুমু খালা যখন সেই জিপার টানাটানি করে খুলছে তখন টুনি আবার ফ্রাস্কের গরম পানি ফেলে দিয়ে সেখানে ট্যাপের পানি ভরে রাখল। খানিকক্ষণ পর টুনি যখন গরম পানি আনতে গিয়ে দেখে পানি ঠান্ডা হয়ে গেছে তখন ঝুমু খালার আর কোনো সন্দেহ থাকল না যে এই ফ্লাস্কটা নষ্ট হয়ে গেছে। চায়নিজ মাল কেনা যে খুবই বোকামি হয়েছে ঝুমু খালা সেইটা বারবার মাথা নেড়ে বলতে থাকল!
.
রাত্রে বসার ঘরে দাদির পায়ে রসুনে ভাজা গরম তেল মাখাতে মাখাতে ঝুমু খালা যখন বাসার সব খবর রিপোর্ট করছিল তখন বড় ফ্লাস্কটা নষ্ট হয়ে যাবার খবরটাও সে দাদিকে রিপোর্ট করল। টুনি ঠিক পাশেই বসেছিল, সে দাদিকে বলল, “দাদি এই নষ্ট ফ্লাস্কটা আমি নিই?”
“নে। কিন্তু নিয়ে কী করবি?”
“ভেতরে মাটি ভরে আঙর গাছ লাগাব!”
“আঙুর গাছ?” দাদি অবাক হয়ে বললেন, “আঙুরের গাছ পাওয়া যায় নাকি?”
“যদি না পাই তাহলে অন্য কিছু করব!”
পরদিন বিকালবেলা টুনি টুম্পাকে নিয়ে সেই “অন্য কিছু করার জন্যে বড় ফ্লাস্কটা নিয়ে বের হলো। রাস্তার মোড়ে একটু খোজাখুঁজি করতেই গুল্লু এবং বাঘাকে পাওয়া গেল। মুখের লাল রং একটু কমেছে কিন্তু পুরোপুরি ওঠেনি।
টুনি গুল্লুর দিকে ফ্লাস্কটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও।”
গুল্লু অবাক হয়ে বলল, “নিব? আমি?”
“হ্যাঁ।”
“কত টাকা?”
টুনি আর টুম্পা হেসে ফেলল। টুনি বলল, “তোমাকে টাকা দিতে হবে। এটা তোমাকে গিফট।”
গুল্লু তখন প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ফ্লাস্কটা হাতে নেয়। তাকে দেখে বোঝা যায় টুনি আর টুম্পা হঠাৎ যদি সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে সে সেই ঝুঁকি নিতে রাজি না। ফ্লাস্কটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বলল, “সত্যি আমারে দিয়ে দিলা?”
“হ্যাঁ।”
“খোদার কসম?”
টুনি বলল, “খোদার কসম-তবে একটা শর্ত।”
“কী শর্ত?”
“আর কোনোদিন পেপার চুরি করতে পারবা না।”
গুল্লু দাঁত বের করে হাসল, বলল, “করমু না।”
“গুড।” টুনি বলল, “মনে রাখবা আমরা কিন্তু তোমার বিজনেস পার্টনার। তার মানে কি জানো?”
“কী?”
“আমাদের দুইজনকে ফ্রি চা খাওয়াতে হবে।”
গুল্লু দাঁত বের করে হাসল, বলল, “খাওয়ামু।”
“আর বিজনেস করে যখন তুমি বড় হয়ে অনেক বড় বিজনেসম্যান হবে, বিল গেইটসের মতো একজন হবে তখন আমাদের দুইজনকে দুইটা গাড়ি কিনে দিতে হবে।”
টুনির সব কথা সে বুঝতে পারল না, বিল গেইটসটা কী সে ধরতে পারল না কিন্তু তারপরও তাকে নিরুৎসাহিত হতে দেখা গেল না। মাথা নেড়ে বলল, “দিমু। খোদার কসম।”
একেবারে ফার্স্ট ক্লাস চা!
টুনি আর টুম্পা ছোট বলে বাসায় তাদেরকে সব সময় চা খেতে দেয়া। হয় না। সেটা নিয়ে অবশ্যি এখন টুনি আর টুম্পার কোনো দুঃখ নেই। যখনই তাদের চা খেতে ইচ্ছে করে তারা মোড়ের দোকানের বেঞ্চে গিয়ে বসে, গুল্লু তখন তাদের চা খাওয়ায়।
একেবারে ফার্স্ট ক্লাস চা!
গো-গো-গোল্ডেন ফাইভ
বসার ঘরে দাদি (কিংবা নানি) টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখছেন, বড়দের কেউ কেউ খবরের কাগজ পড়ছে, কেউ কেউ ঝুমু খালার তৈরি পায়েশের মতো চা খাচ্ছে, ছোটরা মেঝেতে উবু হয়ে বসে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলছে–তখন ছোটাচ্চু এসে ঢুকল। বাচ্চাদের একজন মাথা তুলে বলল, “তুমি আজকে কিছু আনো নাই?”