যারা অসাধারণ, কিছু দেয়ার জন্যে জন্ম যাদের, তাদের জন্যে চাই সংসারের চৌরাস্তার চেয়েও আরও অনেক বড় কিছু। চাই অনুভবে, চাই শূন্যতায়। চাই প্রথার কারুকার্যের বাইরে, সৃষ্টির অমূল্য পাথর। চাই কোহিনূর! হ্যাঁ কোহিনূর! এবং এই অনন্য হীরক খণ্ডটি পেতে হলে নিজেকে নিয়ত পুড়িয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার হতে হয়। আর সংসার, এখানে পুড়িয়ে অঙ্গার হওয়ার চেয়ে নিয়ত পোড়া অঙ্গার হতে হয়। এই অঙ্গারে শুধু ছাই আছে। কোহিনূর নেই। সুতরাং অসাধারণ মানুষদের জন্যে চাই, সংসারের বাইরের অন্য কিছু এবং অনেক কিছু, যেখানে তারা খুঁজে বেড়াবে–সেই দুর্লভ হীরক খণ্ডটি।
জীবন, অনুভবের। অনুভব, যা উপভোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার, একধরনের প্রাপ্তিযোগ। আমাদের মধ্যে ব্যক্তিক্রমী কিছু সৃষ্টিশীল মানুষ আছে যারা উপভোগের বদলে অনুভবের মধ্য দিয়ে খুঁজে পায় তাদের সৃষ্টির প্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনা। সংসারে বা সংসারের বাইরে থেকেও, অনুভবের পুঁজিটুকু দিয়ে তারা সৃষ্টি করে শিল্প। সৃষ্টি করে সাহিত্য। আর এই লেখাটি সাধারণ এবং অসাধারণ এই দুই ধরনের মানুষের জন্যে। দুই পিঠে যার, উপভোগের বিরুদ্ধে অনুভব। গৃহীর বিরুদ্ধে প্রথাবিরোধী মানুষ।
আমাদের খিদে পায়। ক্ষুধার কামড় বলে একটা কথা আছে। যতক্ষণ না খাওয়া হবে, ততক্ষণ এই কামড় খাবারের সবরকম রসনা ও আস্বাদনের অনুভূতি দেবে। কিন্তু খাওয়া মাত্রই ক্ষুধার তীব্র অনুভূতি শেষ হয়ে যায়। তখন মনে হতে পারে কেন খেলাম! তেমনই, কাম ও রতি। না পাওয়ার তীব্রতা থেকে অনুভব হয় শরীরের পুলক ও রোমাঞ্চ। কল্পনা, মুহুর্মুহু রতি অনুভবের। প্রেম হয়ে গেলেই, হৃদয় ভরে ধরে রাখা, সেই সুখানুভূতিও চলে যায়।
না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে সৃষ্ট সারাক্ষণ পাওয়ার অনুভূতির মধ্যে সকল পাওয়ার যে নিবিড় সুখ, উপভোগ থেকে তা আসে না। সেই পাওয়াকে বরং তুলনা করা যেতে পারে হারানোর সঙ্গে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষ শুধু অনুভূতি আর কল্পনা নিয়েই বাঁচবে। আসলে বলতে চাওয়া হচ্ছে স্বল্পসংখ্যক, সেই সব মানুষের কথা যারা বাতাসে, জলে, সমুদ্রে, নক্ষত্রে, ঘাসে, যেদিকে খুশি তাকায় না কেন, কিছু না কিছু অনুভব উপলব্ধি করে সেখান থেকে খুঁজে বের করে নিতে পারে, সৃষ্টির জন্যে উপযুক্ত চিন্তাভাবনা।
তবে অনুভবী মানুষগুলো সংখ্যায় বড় অল্প। স্বেচ্ছায় এই কষ্ট, এই নির্বাসন, সহজ কোনও কাজ যে নয়, একমাত্র ভুক্তভোগীরাই তা জানে। তবুও কিছু কপালপোড়া মানুষ এই নিঃসঙ্গতাই বেছে নেয়। পৃথিবীতে তারা সংসারে থেকেও, নির্বাসিত ভেতরে এবং বাইরে। জীবনানন্দের ‘বোধ’ নামের কবিতাটির সঙ্গে কবির এবং আমাদের এই নিঃসঙ্গ নির্বাসনের একটা অনন্ত মিল।
“আলো-অন্ধকারে যাই–মাথার ভিতরে
স্বার্থ নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে!
সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা! …”।
খ. মনে হয় শিল্প ও সাহিত্যের জগতে যত সার্থক এবং স্মরণীয় সৃষ্টি রয়েছে তার অধিকাংশ স্ৰষ্ঠাই নিঃসঙ্গ এবং অনুভবী জগতের মানুষ। এমন সৃষ্টির মধ্যে ‘গীতবিতানের’ নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ্য। গীতবিতান, জীবনের যাবতীয় সঙ্কট মুহূর্তে, সব প্রশ্ন এবং সব উত্তরের বিশ্বকোষ। উত্তর, যা তাৎক্ষণিক। যা সত্য। মনে হবে গানটি একান্তভাবে তারই জন্যে রচিত যে তাৎক্ষণিকভাবে সেই অনুসন্ধানে ব্যাপৃত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আকাশ-সমান ধরন-ধারণ ক্ষমতা ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে। কবিগুরুর সব বয়সের অনুভূতিগুলো, যার সবটাই তার নিজের সঙ্কট হয়েও যা আমাদেরও সঙ্কটের সঙ্গে মিলে গিয়ে রচিত হয়, গীতবিতান। তার অনুভূতি, আমাদের প্রাপ্তি। একজনের অনুভব বিতরণ হয় কোটি কোটি মানুষের সমস্যার উত্তর হয়ে।
গ. আমরা কি নিজেকে চিনি! আমি ও আপনি মিলে আমরা যে চারদিকে সারাক্ষণ অসুখী মানুষের পাহাড় গড়ে চলেছি, এই গুজব কি মিথ্যে? প্রতিদিনই আমরা কি অসুখী নই। কোনও না কোনও অজুহাতে। কেউ সরবে। আবার কেউ-বা নীরবে। যার বিত্ত আছে, যার নেই, সবাই কিন্তু একসঙ্গে গলা মিলিয়ে কীর্তনে যোগ দিই। যে বন্ধ্যা, যে নয়। যার টইটম্বুর, যে শূন্য। ব্যাধিহীন যে, যার শরীরে ক্যান্সার। মানুষ অসুখী, সব উপভোগ, সব অনুভব, সব সত্ত্বেও মানুষ অসুখী। আপন মনে হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস পড়বেই। যে সব পেয়েছে, আরো চাই বলে। যার কিছুই নেই, সামান্য চাই বলে। চেয়ে চেয়ে শুধু কাঙাল হওয়া। সংসারের দায়িত্বে পড়ে আমরা ভুলে গেছি, আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ নিজেকে চেনা। আমাদের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো সংসারের তাগিদে যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
সংসার থাকলে, চাহিদা ও সমস্যা থাকবেই। এবং সে কারণে নিজের সঙ্গে একটা সমঝোতা গড়ে নিতেই হয়। সংসারী মানুষের থাকে কতরকমের দায়বদ্ধতা। ছেলেমেয়ে, রোজগার, আত্মীয়স্বজন। মানুষদের জীবন থেকে সংসার গিলে খায় সময়। সময় গিলে খায়, বয়স। আর সংসারের গর্ভে হারিয়ে যায়, সময় এবং বয়স দুটোই। সৃষ্টিশীল মানুষদের জন্যে সংসারের সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতা, সর্বনাশের চিহ্ন।
উপভোগ আর অনুভবের নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা ঠিকঠাক দেয়া কি সম্ভব। বিষয়টা-মনস্তাত্ত্বিক। শুধু চোখ দিয়ে দেখে, কান দিয়ে শুনে, যা দেখি, যা বুঝি, তাই বোঝাতে চাই। অনুভবের যেমন রয়েছে উত্তাপ। উত্তাপ, যা জ্বালিয়ে দেয় বোধের কোষ। সেই জ্বালানো-পোড়ানো থেকে সৃষ্টি হয় কোহিনূর। কিন্তু সংসারী মানুষদের মধ্যে যারা সৃষ্টিশীল তারা সংসারের দায়িত্বে ক্লান্ত হতে হতে একসময়, নিরুত্তাপ হয়ে ওঠে বলেই তাদের বোধের কোষে সৃষ্টির আর কোনও যন্ত্রণা থাকে না। ফলে তারা হতাশা নামক শূন্যতার এক অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়। এজন্যই মহাজনরা সংসারের নাম রেখেছে সৃষ্টিশীলদের জন্যে সর্বনাশের তীর্থক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথও কি বলেননি, ‘সেদিন চৈত্রমাস/তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।‘ সংসারের তাগিদে এই অবক্ষয় প্রথম অনুভব হয় যে বয়সে সেটাই মধ্য বয়স।