গ. কামুক নারী হতেই পারে তার শারীরিক চাহিদা, পুরুষটির স্বাভাবিক ক্ষমতার চেয়ে বেশি। নারীর চেয়ে এই সমস্যা বেশি অবশ্য পুরুষেরই। কিন্তু এমন নারী আছে যার যৌন চাহিদা ঠিক মিটছে না। তারপরও বছরের পর বছর সে অতৃপ্ত যৌন জীবনযাপন করতে করতে একসময় যদি তার শরীর এবং দেহ মন বিদ্রোহ করে ওঠে তখন কি তার করণীয়। এমতাবস্থায় সে যদি কোনও পর পুরুষের সাথে দেহ মিলনে লিপ্ত হয় তাহলে তার অন্যায়টা কোথায়? স্বাভাবিক নিয়মে প্রকৃতির এই প্রয়োজনীয়তায় সাড়া দেয়াটাই কি তার অপরাধ! -ভাত কি কেউ মেপে খায়? যতবড় পেট, যত ক্ষুধা, ভাত, ততখানি লাগে।
মধ্য জীবনের সঙ্কট, বিদ্রোহ বিপ্লব কি শুধু স্বাধীনতা কিংবা নুন-পেঁয়াজ গ্যাসোলিনের দাম কমানোর বেলাতেই প্রযোজ্য?
শরীরী প্রয়োজন কেন বিপ্লব বিদ্রোহের বাইরে থাকবে? শরীরে যখন উত্তাল হরমোন এসে বয়ঃসন্ধিকালের টিনএজ শরীরটিকে টলিয়ে নড়িয়ে দিয়ে যায়, যখন কিশোরদের কচি মুখে গোঁফের হালকা রেখা কিংবা কিশোরীদের শরীরে কচি পেয়ারার মতো স্তনের উদ্দাম ঘটে, তখন এই শারীরিক পরিবর্তন কি প্রকৃতির ন্যায্য বিপ্লব নয়? যৌবনে, যখন নারী-পুরুষ রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয় পরস্পর পরস্পরের সাথে, সেটা কি অনুভূতি বদলা-বদলির হার্দিক বিপ্লব নয়? দশ থেকে কুড়ি বছর বিবাহিত জীবনযাপনের পর মন-শরীর-অনুভূতি যখন বিগত কুড়ি বছর থেকে আলাদা হয়ে অন্য অনুভূতির পোশাক গায়ে চড়ায়, অন্যরকম কুড়ি বছরের জন্য তৈরি হয়, তাকে কি আমরা সময়ের বিপ্লব বলবো না!
মানুষ এক বাড়িতে চিরদিন বাস করে না। পোশাক, আহারের রুচি, অভ্যেস সবই পাল্টায়। এটাই নিয়ম। এটাই শাশ্বত। পুরুষ একাধিক নারীর কাছে যেতে রুচিবোধ করে। কিন্তু সমস্যা হলো নারীর মন-শরীর-অনুভূতি নিয়ে। এই ত্রয়ী’ যখন একসঙ্গে বিদ্রোহ করে বসে, সমাজ-ধর্ম এবং সংস্কার, তখন একযোগে বলে ওঠে–সর্বনাশ!
সর্বনাশ হোক আর বিপ্লব হোক একথা মিথ্যা নয় যে মধ্য জীবনের সঙ্কটে আক্রান্ত হয় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বিবাহিত নারী ও পুরুষ। পশ্চিমে বিবাহ বিচ্ছেদের হার যে পঞ্চাশ শতাংশ, এটিও তার একটি অন্যতম প্রধান প্রমাণ। কিন্তু পূর্বে, যেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ –নারী স্বাধীনতা ইত্যাদির বালাই কম, কিংবা নেই বললেই চলে, সেসব দেশে এই সঙ্কটের আবর্তে পড়ে মুক্তচিন্তা বর্জিত অল্প ও অর্ধশিক্ষিত নারীরা কূপমণ্ডুক সমাজে এই বিপ্লব, না বুঝতে পারে, কিংবা বুঝলেও না তার কোনও সঙ্গত জবাব দিতে পারে। ফলে একগাদা সন্তানের জন্ম দিয়ে অকালে জীবন-যৌবন হারিয়ে আমাদের মধ্য বয়সী মা-মাসি-চাচি-মামি তারা নিজেদের অজান্তেই মধ্য জীবনের সঙ্কটে অনিবার্যতায় পড়ে যায়। শতকরা পঞ্চাশ ভাগই অল্প কিংবা বিস্তর মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভোগে। এই অসুস্থ মা-মাসি-চাচি মিলে আমাদের মেয়েদের জগৎটা আজও উপচে পড়ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে আমাদের এই মা-মাসিদের মধ্য বয়েসের নিঃসঙ্গতা-মানসিক কষ্ট-হতাশা-ব্যথা-বেদনা বোঝার মতন আশপাশে কাউকে দেখা যায় না।
অন্যদিক পুরুষের ক্ষেত্রে এই সব সঙ্কটের তেমন কোনও বালাই আছে বলে মনেই হয় না। পুরুষটির কাছে কেউ জানতে চাইবে না কেন তার ঘরে ফিরতে এত রাত হলো। কোথায় গিয়েছিল! কোন কাজে! কেউ অনুসরণও করবে না তার গতিবিধি। কারণ সে পুরুষ। তার জগৎটাই ঘরের সীমানার ঠিক বাইরে থেকে শুরু হয়। আর নারীর বেলায় পুরোপুরি উল্টোটা। তার সীমানা শেষ হয়, যেখানে পুরুষের শুরু।
যে-সব নারী জীবন মধ্যাহ্নের তাড়নায় আক্রান্ত হয়েছে বুঝতে পেরে সেটাকে স্বীকার করে নেয়ার মতো সাহস দেখাতে পারে, সমস্যা সেই সব নারীদের নিয়ে। সে যাবে তার কাছে, যাকে তার ভালো লাগে। সেজন্যে সে সবরকম মিথ্যাচার-অনাচারের মুখোমুখি হতে পারে, পথেঘাটে। যত শ্বাপদসঙ্কুল সাহায্য-সহযোগিতা নিতেও কুণ্ঠিত বোধ করবে না। হোক না কন্টক যেতে হলে সে যাবে। কারণ এই নারী আত্মঘাতী কোনও নারী নয়। এই নারী-সত্য। এই নারীকে আমার স্যালুট। কিন্তু সমাজ এই নারীর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। তাতে নারীর কি কিছু আসে যায়? যায়। কোনও কোনও বর্বর সমাজে, যায়। এবং ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ। ধর্ম আবার সর্বাগ্রে কোণঠাসা করে নারীর অধিকার। অপচয় করে নারীর জীবন। সমাজ যা ধর্মভিত্তিক ধর্ম যা সমাজভিত্তিক দুটোই নারীর চরম শত্রু। এবং ধর্ম, সমাজ, প্রকৃতির বিরুদ্ধে। মধ্য বয়সের এই সমস্যার কারণ, প্রকৃতি! প্রকৃতির তাড়না। হরমোনের কেমিস্ট্রি। পরিবেশ এবং পরিস্থিতি। পুরুষ পারে–নারী পারে না। নারী নানান সঙ্কট শরীরে পুষে নিজে নিজে দগ্ধ হয়, পাকানো দড়ির আগুনের মতো ধীরে ধীরে, সে পুড়ে যাবে জানে বলেই, পুড়তে থাকে, নিঃশেষ না হওয়া অবধি।
৩২. হাত নয় যেন, সাপ
কখনো কোনও কাক্ষিত আনন্দ কি হঠাৎ বিষাদে পরিণত হতে পারে না? কখন, কার নিষ্ঠুরতায়, কিভাবে, সে আনন্দ যে ধুলোয় লুটায় তা কি কেউ অগ্রিম বলতে পারে? পারলে, পৃথিবীর সব আনন্দই কেন স্থায়ী হয় না? কেন নিশ্চিত হয় না? কখনো কখনো কোনও স্মৃতি কেন হয় আজীবন পরিতাপের? অভিজ্ঞতা হয় অসুন্দর।
বছরে একবার মার সাথে দাদুবাড়ি যেতে হতো শীতের ছুটিতে। দাদুবাড়ি পাবনা ছাড়িয়ে এক গহিন গ্রামে। সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থাটি ছিল খুব দুর্গম। প্রথমে ব্ৰহ্মপুত্র পার হয়ে ট্রেন। ট্রেন থেকে লঞ্চে নদী পার হয়ে ঈশ্বরদী। সেখান থেকে বাস নিয়ে মাসুন্দিয়ার দাদুবাড়ির ঠিক চার মাইল আগে। বাসটি থামতো। কাঁচা রাস্তা। এই চার মাইল বাস আর যাবে না। বাধ্য হয়ে হাঁটতে হতো গ্রামের ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে, দীর্ঘ পথ। কিছুক্ষণ পরপর পায়ে ফুটতো ছোট ছোট কাঁটা। কাঁটা টেনে ধরতো জামা, প্যান্ট। আমার তখন হাফ প্যান্ট আর ফ্রক পরার বয়েস। মা কেঁচড় ভর্তি গুড় আর মুড়ি দিয়ে দিতেন। মুঠোভর্তি করে গুড়-মুড়ি খেতে খেতে হাঁটতে থাকতাম বাড়ির দিকে। চার মাইল পথ। মা, কাকা, আর আমরা তিন বোন।