এবার ক্লাস টেনের পড়াশোনা। প্রি-টেস্ট শেষ হয়ে টেস্ট শুরু। লতা গুড় ভাজ করছে নিয়মিতই, কিন্তু একটা অস্থিরতা ওর মধ্যে আমার কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। ওর গলায় এক জোড়া ঠোঁটের লাল চিহ্ন মনে হয় আমি দেখেছিলাম। গলায় একজোড়া ঠোঁট যেন আকাশে চাঁদের মতো ঝুলে আছে। ওড়না দিয়ে ঢেকে লুকোতে চাইছিল কিন্তু আমার চোখ সে এত দ্রুত এড়াতে পারেনি। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক বলেই মনে হলো এবং সেই থেকে ওর দিকে আমি গোপনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলাম। সৎ মা দেশে, বাবা ফেরে গভীর রাতে। রাতের অন্ধকারে ওকে বাধা দেয়ার কেউ নেই। থাকলেও পৃথিবীর অন্যান্য নিষ্প্রয়োজনের মতোই, কেউ তার প্রয়োজন মনে করে না। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে, শুধু আমারই গোপন চোখ, ওর পায়ে পায়ে, হেঁটে বেড়ায়। গলির ভেতরে, হাঁটে। এমনকি দীননাথ কাকিও সে খবর জানে না।
আমি সেদিন পড়ছিলাম, পরীক্ষার পড়া। কার পায়ের শব্দ যেন আমারই কানে আসে। অস্থির হাঁটা, একটু অস্বাভাবিক হাঁটার শব্দ, নিশ্বাস, পালিয়ে বেড়ানো অস্বাভাবিক নিশ্বাস, দৌড়ে যায় আমারই কানের পাশ দিয়ে। পেছন পেছন আমিও গেলাম, পরিচিত সেই চাপা গলিটার ভেতরে। লতা টের পেলো না। আমি গেলাম গোপনে, পা টিপে। হার্টের ড্রামপেটানোর শব্দগুলোকে একটা একটা করে গিলে খেতে খেতে।
লতা হনহন করে দ্রুত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। পিঠভর্তি চুল। কুচি দেয়া গোলাপি রঙের ফ্রক, পরনে। যেন অন্ধকারে সে কিছুতেই লতা নয়। যেন শেওড়া গাছের ভূত। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি, লতা কি দ্রুত অর্ধ উলঙ্গ হলো। যেন শেখানো। যেন স্কুল থেকে শিখে এসেছে। পাজামাটা ওর হাঁটুর নিচে। দীনু কাকার বিশাল শরীর ওর শরীরের ওপরে। কাকা গা দোলাচ্ছে। আমার চোখের সামনে নরনারী পত্রিকার ছবি, ছবির বদলে লতা আর কাকা। এরকম গা দোলানোর দৃশ্য আমার কাছে নতুন নয়। অন্যদিন কাকার সঙ্গে ছিল মালতীর মা। টুলি মাসির সঙ্গে সদানন্দ কাকা। ভোলাদা আর বেনুদি। মাসুদ, হেলাল, কাজল সঙ্গে সাথী, কচি, কবিতা। মালা আর মল্লিকা। শিশির আর হারাধন। আমি ফিরে এলাম হতবাক। বোকা। ঘামে ভেজা।
তার চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই লতার মৃত্যু সংবাদ শহরে ছড়িয়ে পড়লো। বাড়িটা ভরে গেল অযাচিত মানুষের ভিড়ে। যারা শুধুই কৌতূহল খুঁজে বেড়ায়। লোকজন কি সব নষ্ট কথা সব বলতে শুরু করলো। শুনে, আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি বলছে ওরা এসব! লতার পেটে বাচ্চা? আকাশে তখন মেঘ, সাথে দুর্যোগ। শুরু হলো, ঝোড়োবৃষ্টি, সঙ্গে বিজলি। দুয়ারে লতার মৃতদেহ নিয়ে বসে রয়েছে কয়েকজন বেকার মাতাল। কয়েক বোতল মদ ওদের জন্য অপেক্ষা করছে শ্মশানে। বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ওরা মৃতদেহ সামনে রেখে মদের নেশার গল্পে ব্যস্ত। অন্যরা ব্যস্ত লতার পেটে ভ্রূণের গল্পে। ক’মাসের। কার ভ্রূণ। কোন পুরুষ এদিকে আসেনি দু’মাস! কাকে দেখা গেছে এড়িয়ে যেতে! কার মায়ের চোখের তলে কালি। কার মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের বাড়ি যায় কে? কার সংসারে হঠাৎ দাম্পত্য কলহ শুরু হলো। কে কোন ঘরে-কোথায়…।
ক’দিন পরের কথা। সেই গলিতে আমি আবার ফিরে গেলাম। একা অজানা কৌতূহলে, গলির মধ্যে পরিত্যক্ত তোশক আর কয়লা ছাড়াও সেদিন দেখেছিলাম, বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাওয়া দু’টুকরো সাবানের অবশিষ্ট। আর একটা ছোট পিচকিরির মতো।
সেদিন বুঝিনি, এসবের অর্থ। তবে এখন বুঝি। বুঝি ওর মৃত্যুর কারণ। গর্ভপাতের ভুল চেষ্টা। পিচকিরিতে সাবানের জল ভরে। যা লতার জীবন কেড়ে নিয়েছিল। লতা নেই তবে দীননাথ কাকা আজো বেঁচে আছে। দোকানে বসে এখনো সে লাল-নীল কাঠি লজেন্স বিক্রি করে।
কাকার এই বৃদ্ধ বয়সে কাকির প্রতি অস্বাভাবিক রকমের মনোযোগের কারণে দীনু কাকি মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হয়ে কিসব বলে। বুড়ো বয়সে পঙ্গু স্বামীকে টানতে হয় বলে অসুখী কাকি মাকে নিয়মিত অভিযোগ করে বলে, মরদ এহন যায় না গলির পেছনে! ক্যান যায় না? কাকি, আগের মতো আর অনুতপ্ত নয়। সে কষ্ট করে ওসব গলির পেছনে যায় না। বরং পাশের বাড়ির বৌ মরা গীতার বাবার সঙ্গে, চা খেতে খেতে ঘরের ভেতরেই দীর্ঘ সময় কাটায়। অর্ধেক পঙ্গু দেহী কাকার সেসবে কোনও মাথাব্যথা নেই।
৩১. নির্বোধের অনেক দোষ
পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষেরই বাঁচার অধিকার তার নিজস্ব, পৃথিবীর প্রতিটি নারীর স্বাধীনতা তার ব্যক্তিগত। আমি অনুভব করি, আমার অনুভূতিগুলো কোনও রকমেই পুরুষের চেয়ে ভিন্ন নয়। সোজা কথা এটা জীবনের অভিজ্ঞতা। এর চেয়ে বেশি কিছু কি আর বলার আছে! নারীর শরীরে অভ্যস্ত পুরুষ, নিজেই কি তা বোঝে না? সত্যিই বোঝে না! নারী ছাড়া কি পুরুষ, হয়? বনের পশুও তাড়না বোঝে। নদীর তৃষ্ণা হলে নদী, আকাশ বোঝে। পৃথিবী উত্তপ্ত হলে, পাহাড়ের নির্বাক গাছে বাতাস ফোটে। কামার্ত ঝিনুক পেটে বালির কনা ঘষে সঙ্গম মিটিয়ে তবে–গর্ভে ধরে, মুক্তো। আর নারী-পুরুষের সমান চাহিদা আছে বলেই দুটি হৃদয়ের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ যোনি আর লিঙ্গে ঘটে সঙ্গমের মতো একটা সুন্দর প্রক্রিয়ায়। সেখানে ঠিক সেই মুহূর্তে দুই বিপরীত লিঙ্গের মানুষ সম্পূর্ণ এক হয়ে, দু’জনেই একই সমতলে, এক সমান হয়ে যায়। মাস্টার অ্যান্ড স্লেইভ, সখিনা আর মনু মিয়ার কামের অনাবিল এই মুহূর্ত, কোনওরকম বিত্ত, মর্যাদা, অবস্থান ও যুক্তিতর্কের বাইরে। স্বর্গসুখতুল্য এই প্রক্রিয়া, এই অনুভব কোনও রকমেই নারী ও পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। এতদসত্বেও নারীর অবস্থান কেন পুরুষের নিচে হবে তা আমাদের মাথায় আসে না। বহুবিবাহ কেন শুধু পুরুষের বেলায় প্রযোজ্য তাও আমাদের বোধগম্য নয়।