ক্লাস সিক্সের পরীক্ষায় লতা দুই সাবজেক্টে ফেল করে বসলো। সৎ মা অকারণে ওর স্কুল বন্ধের ঘোষণা দিয়ে, পাড়ায় জানিয়ে দিলো–অর মাথায় খালি গুবর আছে। লতার মাথায় যে শুধু গোবর আছে সৎ মা না বললেও আমি জানি। এবং কেন আছে সৎ মা না জানালেও আমি জানি। জন্মেই মা মরা এই মেয়েটি, জন্ম থেকেই অযত্ন আর। অবহেলায় আগাছার মতোই বড় হয়েছে। সুতরাং ওর মাথায় গোবর না থাকাই অস্বাভাবিক। লতার স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে প্রথম প্রথম আমারই কষ্ট হতো বেশি। কারণ গোবর মাথার লতা আমার প্রতিটি অবসর মুহূর্তের সঙ্গী।
মাধবীলতার সঙ্গে এই আচমকা বিচ্ছেদ, আমাকে নড়িয়ে দেয়। হৃদয়ে একটা ব্যথা প্রথম অনুভব করি যা আগে কখনো করিনি। এবং বুঝতে পারি পরবর্তীকালে আমার অনুভূতিগুলোর কুঁড়ি এখান থেকেই জন্ম নেয়। প্রথম, মাধবীলতাকে ঘিরে পরে জীবনে চলার পথে অন্য অনেককে ঘিরে। হৃদয়ের সেই প্রতিনিয়ত প্রেম ও ভালোবাসার ঘূর্ণি, এই সর্বনেশে সঙ্কট থেকে মুক্তি, মাধবীলতা পেলেও, জীবনে আমি কখনোই পেলাম না।
এভাবে কেটে গেল আরো দু’বছর। আমারও পড়ালেখার চাপ বেড়ে যায়। ক্লাস এইটে বৃত্তি দিতে হবে। সেন্টার পড়েছে, জেলা শহর ময়মনসিংহে। প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূরে। বাসে, নৌকোয় ব্রহ্মপুত্রের ওপারে যেতে লাগবে প্রায় ঘণ্টা দশেক। এদিকে লতার বিয়ের জন্যে ওকে দেখতে ছেলের অভিভাবকেরা আসতে শুরু করে। এর মধ্যে দুইজনের বন্ধুত্ব আরেক ধাপ শিথিল হলো। আমি ব্যস্ত। বাধ্য হয়ে লতাও দূরে সরে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ এসে চুপ করে আমার পড়ার বইগুলো দেখে। আমি না বললে, সেও কোনও কথা না বলে চলে যায়। একটা অস্থিরতা ওর মধ্যে স্পষ্ট। কিন্তু আমি নিরুপায়। তার কিছু দিন পর। বেকার লতা একটা কাজ পেল। গুড় ভাঁজ করার কাজ। কাজটি ওকে দিলো দীনু কাকা।
মার মহিলা সমিতির আসরে অমনোযোগী স্বামীদের অবহেলিত বৌগুলোর সদস্য সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অকাল বিধবা টুলি মাসি তার কাম-রতি পুরোপুরি নিবৃত্ত করতে এবার মাছ খাওয়া ছেড়েছে। কিন্তু সদানন্দকে সে ছাড়তে পারেনি। প্রতিরাতেই সদানন্দ আসে গলির পেছনে, আর লোক দেখানোর জন্যে চুল আরো কেটে, রঙিনের বদলে সাদা শাড়ি ধরেছে। অনেকগুলো শিবলিঙ্গ কিনে সে তার শোবার ঘরের পাশে ছোট মন্দিরটুকু ভরে ফেলেছে। মহিলাদের আসরে বসে মাসি নিয়মিত দাবি করে বলতো, মাঝ রাতে তার শিবলিঙ্গ দেবতার রূপ ধারণ করে। সে নিজ হাতে শিবকে খেতে দেয়। অনেকরকম জটিল চিন্তার মানুষ আমি কাউকেই বললাম না গভীর রাতে যখন সবাই ঘুম, আমি তখন পড়ার ফাঁকে জানালা দিয়ে টুলি মাসির ঘরে তাকিয়ে কি দেখেছিলাম। সদানন্দ কাকা কাকিকে বারবার জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে চলছে তো চলছেই। ওদের এরকম আদর দেখে প্রথম বুঝেছিলাম বিদ্যাসাগর আর রামমোহন রায়ের কথা। বুঝেছিলাম আমার সধবা মায়ের মতোই, বিধবার হৃদয়েও যে প্রেম আছে, থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কাম আর রতি আছে। একমাত্র আমি বাদে সবাই অবাক হয়ে মাসির দেবতার গল্প শোনে।
দীননাথ কাকি, একজন চির অসুখী। যার না জীবন, না যৌবন কোনওটাই সুখের হলো। তার অভিযোগ একগুণ থেকে লাফ দিয়ে তিনগুণ হলো লতাকে যেদিন কাকা গুড় ভাজ করার কাজটা দিয়ে দিল। এই কাজটা কাকিই করতো। করে হাতে কিছু পয়সা পেতো। কাকি এ নিয়ে অভিযোগ করলেই কাকা বলে, বাড়ি ছাইরা যাও। মা বলেন, তুই কুথায় যাবি। তর তো যাওনের কুনো জায়গা নাই। কাকির একমাত্র শান্তি, নিরন্ত কি কান্না। কাকি গানের সুরে, কাঁদে। কাকা দোকান থেকে জোরে ধমকে দিয়ে বলে, চোপ …।
মাঝখানে পেরিয়ে গেল আরো একটা বছর, ক্লাস এইটের বৃত্তি পাইনি। কিন্তু সেই থেকে যথেষ্ট পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা আমি অনুভব করি। বিশেষ করে ক্লাস নাইনের ফাইনালেরও বেশ কিছু আগে থেকে তার সঙ্গে এমনকি প্রতিদিনকার নিয়মিত দেখাশোনাটিও তেমন হতো না। এদিকে তার বিয়ের যে সম্ভাবনা ছিল, সেটিও স্তিমিত হয়ে আসছিল যৌতুকের কারণে। একসময় ওর সৎ মা বিয়ের প্রসঙ্গটিও ইচ্ছে করেই ভুলে গেল।
আমি ম্যাট্রিকের প্রি-টেস্টের পড়া পড়ছি। মা দুটো অতিরিক্ত মাস্টার রেখেছেন। ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন চাই বলে বাবা তার আগাম রায় দিয়ে দিয়েছেন। স্কুলের হেডমাস্টার তার আশা-ভরসার লিস্টে আমার নামটা ঝুলিয়ে দিয়ে প্রতিদিন একবার করে মনে করিয়ে দেন আমাকে কোন ডিভিশন পেতে হবে। লতা এলেও তেমন আর সুযোগ পায় না কথা বলার। বসে বসে শুধু বইয়ের স্তূপ ঘাটে। কিন্তু বেশ কদিন ধরে লক্ষ্য করছি ও যেন কি বলতে চায়। কিন্তু বলতে গিয়েও বলে না।
একদিন সৎ মার বাবা মারা যাওয়াতে সৎ মা দেশের বাড়িতে চলে গেল। সেখানে সম্পত্তি ভাগ করার কিছু ব্যাপারও আছে। লতা বাড়িতে একা। সৎ মা আসবে মাস তিনেক বাদে, সম্পত্তির ভাগ নিয়ে তবেই। এদিকে দীননাথ কাকি মার কাছে লতার নামে নালিশ করে নিজস্ব ভাষায় বলে যে, মেয়েটি বড় বেহায়া। কাপড়-চোপড়ের কোনও ঠিক নেই। লম্বা পা উদোম রেখে, যখন-তখন দোকানে যায়। মা জানেন লতা তেমন মেয়েই নয়। ঈর্ষা, যেহেতু ওর কাজটা লতা করছে ভেবে, মা কাকির অন্য অভিযোগগুলোর মধ্যে এই অভিযোগটিকেও উড়িয়ে দেন। মা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুই কি কিছু দেখছস? আমি তো দেখি নাই। বললেন মা। মায়ের কথায় আমি সায় দিলেও, তার সবটুকুই মেনে নিতে পারলাম না। মা বললেন, ওইসবে কান দিয়ো না। লতা-ওইরকম মেয়েই না। কাকির মন থেকে সন্দেহ তবুও দূর হয় না।