আমার কষ্ট হতো দীনু কাকিকে দেখলে। কাকি প্রতিদিন একবার করে মার কাছে আসতো। মার সঙ্গে বসে পান পাতা খেতে খেতে কাকার চরিত্রের নিয়মিত দোষগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলে প্রতিদিন সে একই স্বস্তি খুঁজতো। কাকার এই দোষ; কাকার সেই দোষ কিন্তু নতুন কিছু নয়। পুরোনো অভিযোগ নতুন ভাষায়। ছোটবেলায়, কাকিকে আমি প্রথম দেখেছিলাম টকটকে সুন্দরী এক যুবতী। অথচ চোখের সামনে কি দ্রুত সে বুড়িয়ে গেল! কপালের চামড়ায় রুলটানা ভজ, চোখের তলে কালি। এ যেন অন্য এক কাকি। অকালে বুড়িয়ে যাওয়া কাকির শরীরে তখনো ঋতু হয়। শরীরে কামনা হয়; মনে অনুভূতি হয়। মাকে, কাকি গোপনে সেসব কথা বলে। বলে ছয়জন সন্তান-শেষে কাকা, কাকিকে আর স্পর্শ করেনি। মা, কাকিকে বুঝিয়ে বলেন, কুথাও তোর যাওনের। জায়গা নাই। মালতীর মায়েরে তুই তাড়াতাড়ি কৌশলে বিদায় কর। কাকি বলে, দীনু কইছে, তাইলে সেও বাড়ি ছাইরা চইল্যা যাবো। মালতীর মা, বাড়ির কাজের মেয়েলোক। আমার কানে বাজে অন্ধকার গলিতে সেদিন রাতে ফিসফিস গলায় মানুষের আওয়াজ। সেই গলিতে সেই অন্ধকার রাতে আমি আর লতা কাকে দেখেছিলাম। কি দৃশ্য দেখেছিলাম সে কথা কাউকে বলিনি এমনকি কাকিকেও না। মালতীর মায়ের শরীরের ওপরে দীনু কাকার অর্ধ উলঙ্গ শরীর।
গ্রামের অলিগলি। এক ভিন্ন জীবনের জন্য নিশ্চিন্ত জায়গা। এখানে আসে সময়ের বিভিন্ন প্রহরে ভিন্ন রকমের রকমারি মানুষগুলো। এখানে সবাই সবাইকে জানে, চেনে। জেনেশুনেও একজন আরেকজনকে না চেনার ভান করে। এখানে এসে তখন ওরা চাচা, দাদা, নানা, খালাত ভাই সম্পর্ক ভুলে যায়। এখানে সবাই কামার্ত জানোয়ার। এখানে। সবার শরীর থেকে বেরোয় কামের গন্ধ। চামড়ার গন্ধ। কে মামা, কে ভাই। এখানে সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক, দুটি মাত্র প্রত্যঙ্গ আর সেই সঙ্গে অধরোষ্ট, দাড়িম্ব আর কবি বর্ণিত অনন্ত রূপসুধা পান ইত্যাদি ইত্যাদি।
গ্রামে, বালিকাদের ঋতু এবং বালকদের কণ্ঠস্বর ভাঙার আগেই গ্রামের ছেলেমেয়েদের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ওরা ছোটবেলা থেকেই অভিভাবকহীন জীবনে অভ্যস্ত বলে নিষিদ্ধ পথঘাটগুলো দ্রুত চিনে ফেলে। এভাবেই ওরা, অকাল পক্ক। এবং প্রায় বাড়ির পেছনের অব্যবহৃত আনাচে-কানাচে, গুদাম ঘরে, চিলেকোঠায়, অন্ধকারের একটা নির্দিষ্ট প্রহরে অনেকেই এসে জমা হয়। শরীরের সঙ্গে শরীরের অনুসন্ধান করে জানতে ও জানাতে তাদের কচি শরীরের অনুভূতি। কার কেমন প্রতিক্রিয়া। বালিকাগুলো উদোম করে দেয় তাদের সুপুরি স্তন। বালকেরা সেখানে নানা রকম কসরত করে। অনভিজ্ঞ বালকগুলো নোনতা জল ফেলে বালিকাদের মুখে। মধ্য বয়সের মামা, তালতো ভাই সম্পর্কের পুরুষগুলো যায় শরীরের আরো গভীরে। বিনিময়ে পয়সা, যথেষ্ট লজেন্স, চানাচুর এবং চিনেবাদাম, গলির মধ্যেই মেলে। অন্যের শারীরিক অনুসন্ধান দেখতে দেখতে বিকৃত রুচির একটা অভিজ্ঞতা খানিকটা তারা এখানেই অর্জন করে। মেয়ে-মেয়ে, ছেলে-ছেলেদের মধ্যেও অদ্ভুত মিলন এইসব চোরাগলিতেই সম্পন্ন হয়। অশিক্ষিত, আধুনিক, গ্রাম্য বা শহুরে জীবনের এই মানচিত্র, ছোটবেলায় অনেকেরই স্মৃতিতে চেনা পরিচিত বলেই মনে হবে।
রুমকিকে ওর মা গ্রাম থেকে আসা সত্তর বছর বয়সী চাচার সঙ্গে যাত্রা দেখতে পাঠাল। ফিরে এসে দেখে চাচা নেই। কিন্তু রুমকির সাদা হাফ প্যান্ট রক্তে লাল হয়ে গ্যাছে। এ নিয়ে রুমকির মা হৈ-হুঁল্লোড়ের তাগিদ অনুভব করেনি। কারণ এখানে ঘরের পুরুষের মান-সম্মান জড়িত।
বড়দের ধারণা ছোটদের সব কথা বিশ্বাস করতে নেই, কারণ ওরা ছোট। বড়দের ধারণা যে ছোটরা ঠিক বোঝে না, ওরা কি বলে। ছোটবেলায় জেনেছি, ছোট মুখে বড় কথা বলতে নেই। তাই বড়দের নষ্ট গল্প আমি আর লতা স্বেচ্ছায় চেপে যাই। কমল মামা আর কবিতার নষ্ট গল্প আমি জানি। কমল মামার কাছে কবিতাকে গছিয়ে দিয়ে কবিতার মা গীতা পাঠের আসর শুরু করলে সেই থেকে ওর যে অভিজ্ঞতার শুরু হলো, মামা চলে গেলে স্কুল কেটে নেশাগ্রস্তের মতো কবিতা, অলিগলিতে কিছু খুঁজে বেড়াতো। ক’মাস যেতেই, ওর মা গোপনে দু’-দু’বার গর্ভপাতশেষে ওকে, কোনওরকমে এক খোঁড়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাঁচলো।
এক পাষণ্ড বাবা গলির অন্ধকারে, পেছন থেকে জাপটে ধরলো নিজের মেয়েকে। চিনতে পেরে ধরেই ছেড়ে দিলো। কিন্তু পরনের লুঙ্গিটা তখন মাটিতে। ঘরে ফিরে লোকটা আত্মহত্যা করলো।
আমি পড়ালেখা করি ক্লাসে ফার্স্ট হতে। তার মানে এই নয় যে এত দেখাদেখির পর একটা অস্থিরতা আমার মধ্যেও কাজ করে না। তবে আমি এও জানি যে, লতার মধ্যে সেই অস্থিরতা কাজ করে আমার চেয়ে বেশি। পড়া রেখে দীনু কাকার আলমারি থেকে চুরি করে আনা নরনারী, পড়ার বইয়ের পেটে ঢুকিয়ে লতা সেই ছবি দেখে হাসিতে ভেঙে পড়ে। আমি অপেক্ষা করি পড়া শেষ হওয়া অবধি। আর শেষ হতেই আমরা যাই, যেখানে জায়গাগুলো, চেনা। মানুষগুলো তার থেকেও বেশি। তোফা ভাই, মইনুল কাকা, অমলদা, নির্মল মাস্টার–। পাশাপাশি মন্টু-বিলি, উত্তম, মঈন সঙ্গে বিজলী, কবিতা, গৌরী, লিলি …। ভয়ে আমাদের গা কাঁপে। দূরে দাঁড়িয়ে আমি আর লতা এক অলৌকিক পুলকে কষ্ট পাই। কাকার দুই চোখ আমাকে ফেরায় সেই ভিড়ের আমন্ত্রণ এবং লোভ থেকে। কিন্তু কষ্ট কেউ ফেরাতে পারে না। আমি কষ্ট পাই, লতাও পায়। দু’জনেই বলি, দু’জনেই জানি। তবুও যেন না জানার একটা আদিখ্যেতা গোপনেই বয়ে বয়ে যাই।