আমাদের দু’জনেরই ভিন্ন দুই চরিত্র, দু’রকম স্বভাব। দু’জনের বিপরীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদেরকে এতো দ্রুত কাছে টেনেছিল। যেন অনিবার্য চুম্বক।
অনেকেরই মুখে শোনা, ছোটবেলায় আমি ছিলাম ডানপিটে এবং অস্থির স্বভাবের। মা আমাকে শেখাতেন কাপড় ভাঁজ করা, রান্নার মশলা দেয়া। কার পরে কোনটা। মা বলতেন মেয়ে হতে, স্থির হতে। কিন্তু নারীর চিরাচরিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীত আমি, মা যা বলেন শুনি। কিন্তু কি শুনি, মনে রাখি না।
মাধবীলতা আমার ঠিক উল্টো। স্থির এবং শান্ত। বিষণ্ণ চেহারা জুড়ে সুন্দর দুটো চোখ। চিবুকে বড় তিল। প্রতিমার মতো মুখে সুন্দরের অলঙ্কারে ভিড় না বাড়ালেও, বা গালে একটা রক্তজমাট দাগ। সব মিলিয়ে-মিশিয়ে মাধবীলতা আমার চোখেই শুধু নয় বরং শহরের সবার চোখেই পরমা সুন্দরী। ঘরে সত্য, বাইরে ভয়ানক নিষ্ঠুর পৃথিবী, দুটোই বিপজ্জনক। বন্ধুত্বের পাশাপাশি তাই মাধবীলতার ওপর থাকতো আমার অভিভাবকসুলভ দৃষ্টির ছায়া।
লতাদের বাড়ি আমাদের বাড়ির ডান পাশেরটা। দুই বাড়ির মাঝখানে কুল আর কদম গাছ। দীননাথ কাকার মনোহারী দোকানটা বাম দিকে। দোকানে অনেক কিছুর সাথে কাঠি লজেন্স পাওয়া যেতো। লাল-নীল-কমলা …। বাবা ছিলেন হাড় কিপটে বড়লোক। কাকা, বাকিতে বিশ্বাস করতেন না। বাকির নাম ফাঁকি, কাকার কথা। লজেন্সের দাম না দিতে পারলেও খেতে দিয়ে বিনিময়ে, লতা আর আমাকে যে প্রস্তাব দিয়ে বসততা, তা আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না। কাকার খুজলি ভরা পাছা চুলকে দিয়ে লজেন্স খাওয়ার মতো রুচি, আমাদের ছিল না। গ্রামের কাকা-জেঠাদের মধ্যে ছোটদের দিয়ে শরীরী কসরত করানোর এই প্রবণতা, ওপেন সিক্রেট।
মেয়েদের জামার মাপ দেয়া খুব বড় ধরনের একটা সমস্যা। খলিফাঁদের ফিতে বালিকাদের বুকের কাছে এসে আর নড়তে চাইতো না। সরতো না। ফিতে আর আঙুল, আমাদের সুপুরি বুকের আশপাশে ঝড়ে বিধ্বস্ত পাখির মতো স্থির হয়ে বসে থাকতো। পাখিটা নড়েচড়ে উঠলে, ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চেপেও যেতাম, ভয়ে। পোশাক তৈরি করতে গিয়ে, এমন অভিজ্ঞতা, প্রচুর। এ শুধু লতা আর আমার নয়। এ অভিজ্ঞতা অনেকের।
গ্রামে থাকলেও, সাধারণ গৃহস্থ ঘরের বৌ এক রক্ষণশীল স্বামীর স্ত্রী আমার, মা। তিনি ছিলেন একজন আধুনিক মনের মানুষ। দিনের ঝামেলাশেষে, বিকেল হতেই দুয়ারে বসতেন পান পাতা-জর্দা আর তাল পাখা নিয়ে। পাড়ার সধবা-বিধবা ওরাও সবাই আসতো। বসতো গল্পের বৈঠক। অকাল বৃদ্ধ রুনি মাসির স্বামী কি অসুখে মারা গ্যাছে, সে নিয়ে একদিন লাগলো তুমুল ঝগড়া। মাসি বলতে জ্বর। অন্যরা বলতো অন্য কিছু। বলতো, ভদ্রলোক মেথর পট্টির কাছের পতিতালয় থেকে জননেন্দ্রিয়ে গোলগোল চাকা চাকা ঘা নিয়ে এসেছে। যেখান থেকে রক্ত-পুঁজ এসব ঝরে। এক অজ্ঞাত কারণে পালিয়ে যাওয়া মাসির পুরোনো ঠোঁটকাটা এক প্রতিবাদী কাজের মেয়ে বুড়ি নাকি সেই কথা গ্রামসুদ্ধ সবাইকে ইচ্ছে করে রটিয়ে বেড়াচ্ছে। মাসি ওকে কিছু দিয়েই থামাতে পারছে না। অন্যদের তোপের মুখে টিকতে না পেরে মাসি কাঁদতে শুরু করলো। আমি আর লতা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এসব গল্প শুনি। নীলু মাসি বারোটি সন্তানের পর না পেরে নিজেই স্বামীকে পতিতালয়ে পাঠিয়ে শারীরিক অত্যাচার থেকে বেঁচেছে। রচনা মাসি, এক নিশ্বাসে বলে যায়, বারো বছর তার স্বামী তার বিছানায় ঘুমোয় না। ঝগড়াটে একশ বছরের বুড়ি পিসি, প্রতিদিন এক কথা বলে। বিধবা মালতীর দশবার গর্ভপাতের কথা। পিসিমা মাকে কলিকাল শেষ হয়ে এসেছে বলে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়। পিসি নিজেও বিধবা হয় পঁচিশ বছর বয়সে। মার কাছে শুনেছি, বিয়ের সময় পিসে মশায়ের বয়স ছিল ষাট। পিসিমা বিধবা হলে, কটা গর্ভপাত তিনি নিজে করিয়েছেন একথা অন্য কেউ নয়, আশ্চর্য এই যে, বয়সের ভারে মেয়েদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য হারানো-পুরুষ পুরুষ চেহারার পিসি নিজের মুখেই হাসতে হাসতে অবলীলায় সবার সামনে বলে যান।
টুলি মাসিকে দেখে আমার খুব কষ্ট লাগতো। এত অল্প বয়সে, নারীত্বের ভরাট সব চিহ্ন শরীরে বয়ে, চুল কেটে, সাদা শাড়ি পরে, মাংস খাওয়া ছেড়ে কাম-রতি থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে তার সে কি প্রাণান্ত চেষ্টা! মাসির দিকে তাকাই আমি অন্য দৃষ্টিতে। কারণ বিদ্যাসাগর বা রাজা রামমোহন রায় তখন আমার পড়া হয়ে গেছে। এবং ছোটবেলা থেকে মেয়েদের জীবনের সঙ্গে আমি এভাবেই পরিচিত হতে থাকি। হঠাৎ হঠাৎ মাকে অদ্ভুত প্রশ্ন করলে মা বলেন, তুমি বুঝবা না। মনে মনে বলি, আমি কি বুঝি আর কি জানি, মা কেন কেউই সে খবর জানে না। কারণ আমি সেসব কথা। কাউকে কখনো বলি না। বলার ভাষাও জানি না। আমি জানি, অনেকেই যা জানে না। আমি জানি অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন বাড়ির মধ্যখানে দখিনের চাপা গলির ভেতরে গ্রামের বালিকাদের অন্যরকম এক গোপন জীবনের কথা। যে জীবনে, ওদের সাথে নিয়মিত দেখা হয় কামুক বিশেষ করে, মধ্য বয়সের সব মামা, কাকা, দাদা, চাচাঁদের সঙ্গে। যেখানে কেউ কারো আত্মীয় সত্ত্বেও আত্মীয় নয়। পরিচিত সত্ত্বেও অপরিচিত। এক নীল রঙের জীবন।