মেয়েদের আরেকটি অন্যতম জটিল সমস্যা তার জরায়ু। তার মাতৃত্বের পাসপোর্ট যা বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে এই বয়সে। যেমন টিউমার বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। ফলে অনেক সময়েই এই জরায়ুটা তাদেরকে ফেলে দিতে হয়। জরায়ু, একখণ্ড মাংসপিণ্ড, যা হরমোনের ভারসাম্যতা রক্ষার জন্যে জরুরি। ফলে, জরায়ু হারিয়ে নারীর জীবনে বিভিন্ন সমস্যার আগমন হয়, যা সৃষ্টি করতে পারে ছোটখাট ছাড়াও,ভারসাম্যহীনতার সমস্যা।
খ. আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে নারী নির্যাতন অনেকটাই প্রথার সামিল। হবেই, অল্প বা বেশি। বিয়ের পর থেকেই নারীর ওপর পুরুষের যে নির্যাতন তার প্রভাব, সেখান থেকে সৃষ্ট তার মানসিক প্রতিক্রিয়া, এর সবই যৌবনের তারুণ্যে ও শক্তিতে কাটিয়ে ওঠা যায়। মধ্য বয়সে না পৌঁছুনো অবধি ক্রাইসিসগুলো ঠিক বোধগম্য হয় না। বোধ, যা তাকে এই বয়সে এসে জাগায়, তাড়না দেয়। ভাবায়, চেনায়। মধ্য বয়সে আমরা, কি-না ভাবি? যৌবনে যা ভাবতে পারি না, মধ্য বয়স আসে সেই ভাবনাগুলো নিয়ে। সংসার-সন্তান, দায়িত্ব এবং তার প্রভাব। যা, মধ্য বয়সে পৌঁছে জন্ম দেয় একটি বোধের, যা নারীকে করতে পারে অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত! জীবনে সে কি করলো আর কি করলো না। সংসার করার লাভ ও ক্ষতি। এবং ক্ষতি যার বেশি সে ভাববে, সংসারের বিড়ম্বনা তার জীবন থেকে এই যে যৌবনের বছরগুলোকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল, পড়ে থাকা বাকি বার্ধক্য দিয়ে সে করবেটা কী? বার্ধক্য, তার কি কোনও কাজে লাগবে! একমাত্র অসুস্থ হওয়া, পরের গলগ্রহ, বা বৃদ্ধ হওয়া ছাড়া! অথচ তার বিদ্যা তার বুদ্ধি সবই ছিল। সে শিক্ষক হতে পারতো। ব্যাংকে চাকরি করতে পারতো। শিল্পী-সাহিত্যিক অনেক কিছুই হতে পারতো। পৃথিবীতে সংসার ছাড়াও করার বিষয় কি কিছু কম ছিল। তার মনে হতে পারে। কিন্তু সংসার ও সন্তান তাকে সে সময়, বা সুযোগ, কোনওটাই দেয়নি। এখন সময় আছে তবে মন নেই। স্বামীও তাকে যথেষ্ট সময় দেয়নি। কথায় কথায় সে করেছে অপার সন্দেহ, মৌখিক আর শারীরিক নির্যাতন। সুতরাং ”মিডলাইফের অনুভূতি, যদি হয় অতীতের অনুতাপ, তবে তার তাপ রূপান্তর হতে পারে ভবিষ্যতের ক্রাইসিসে।”
এখন সে আর যুবতী নয়। তবে বৃদ্ধও নয়। যদি এখান থেকে সে অন্য কোথাও যায় যাবে, শুধু বার্ধক্যের দিকেই। পরমায়ু শেষের দিকে। ভাটার দিকে। জোয়ারের উল্টো ভাটা। আর যৌবনের উল্টো, বার্ধক্য। তখন কৈশোর আর তার যৌবনের সবচেয়ে বড় সম্পত্তি। তার মাসিক ঋতু যার শুরু হয় বয়ঃসন্ধিতে, যার আগমনে শরীরে যৌবনের জোয়ার নামে, যার উপস্থিতি মানে সে যুবতী, সেই অনন্য সম্পত্তিটুকুও তার এখানে এসেই হারিয়ে যায়। অর্থাৎ সে আর যুবতী নয়। এই অনন্য সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার খেসারত প্রচুর। প্রথমত, তার মানসিক ও শারীরিক জটিলতা। আর দ্বিতীয়ত, তার শরীরে মেনোপজের কারণে যে শুষ্কতার সৃষ্টি হয়, রসক্ষরণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট অসুবিধায়। অনেক পুরুষই তার নারীর শরীর ত্যাগ করে বা অবহেলা করে। অনেকেই পরকীয়া, কেউ কেউ অন্য বিয়ে। মাসিক ঋতু বন্ধ হয়ে যাওয়ার মানে সে এবার বার্ধক্যের দুয়ারে। নারীর মেনোপজ, যার প্রতিক্রিয়া কেড়ে নিতে পারে রাতের ঘুম। জীবনের মায়া।
কালজয়ী শেক্সপিয়রের ভাষায় জীবন একটা রঙ্গমঞ্চ। আর সকলেই এখানে অভিনেতা। আমরা সব অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা এখানে পৌঁছেই ঠিক করে ফেলি নাটকের শেষের অঙ্ক কেমন হবে। জীবনটা কী ক্রাইসিস! নাকি ক্রাইসিস নয়। মিডলাইফে এসে, মানুষ প্রথম অনুধাবন করে নিজের সঙ্গে শরীর, মন ও আত্মার অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ। মিডলাইফ, একটি চরম সত্য। এই নিষ্ঠুর চরম সত্য উপলব্ধির জন্যে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত একটি সময় ও বয়সের একটি কেন্দ্রবিন্দুই হলো মিডলাইফ। সে আসে অনেক অনেক ক্রাইসিস সঙ্গে নিয়ে।
০৪. বাস্তবিক ও মানবিক
ধারালো, অর্থভারি শব্দের ফুলঝুরি ছড়িয়ে আর বুদ্ধির কড়চা নয়, বরং সহজ সরল গদ্যে মানুষের হৃদয়ে মাঝচল্লিশে যে ক্রাইসিসগুলো সহসা এসে হুমড়ি খেয়ে নড়িয়ে দেয় জীবনের খুঁটি। সেসব নিয়েই লিখতে বেশি ভালো লাগে। কারণ বিষয়টা দারুণ বাস্তব ও মানবিক। মানুষের হৃদয়ে যদি সাড়াই না জাগলো তাহলে সে লেখা লিখে লাভ কী? এবং এই কথাগুলো মানুষের কথা। সবার কথা। সব মানুষের। আমি চাই মানুষের কথা বলতে। তাদের দুঃখ-সুখ, তাদের হৃদয়। মাঝচল্লিশ, নারী আর পুরুষের জীবনে, মন ও হৃদয়ের ক্রান্তিলগ্ন। প্রশ্নবোধক বর্তমানকে ঘিরে, অতীতের সাথে ভবিষ্যতের ক্রান্তিকাল। যেখানে ভোর এবং সকালের আলোর সন্ধিক্ষণের মতো জীবনের দুটো সময় একটার মাঝে আরেকটা এসে মিলিয়ে আবার, দিনের আলোয় বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মাঝচল্লিশ, অতীত এবং ভবিষ্যতের সম্মিলিত মঞ্চে নাটকের উৎসবের মাঝপথে, দৃশ্য বদলের অঙ্ক, সমাপ্তির প্রস্তুতির পথে।
জীবন মধ্যাহ্নের নাটকে, সময়ের সাথে সাথে যখন দৃশ্য বদল হয় তখন, শেষ অঙ্কে পৌঁছে বেশি সময়েই দেখা গেছে হাসির বদলে কান্না। শুকিয়ে যাওয়ার বদলে, রক্ত। মূল কারণ পরকীয়া। পরকীয়ার চেহারাই তাই। নীল-নীল মেঘ নদী। সুখ নেই। যাকে না গেলা যায়, না যায় উগরানো। শাখের করাত।