বাংলাদেশে শ্রমের মূল্য অন্য দেশের তুলনায় ঢের কম বলে এখানে গার্মেন্টস শিল্পের বাজার গজিয়ে উঠেছে হাজার হাজার। কম-বেশি বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে। বায়িং হাউজের ব্যবসা খুবই লাভজনক। বিদেশি বায়াররা আসছে দলে দলে। তাদের বিনোদনের জন্য চাই নারীদেহ। যার ফলে বাংলাদেশে গেস্ট হাউজের ব্যবসা এখন সবচেয়ে রমরমা। ব্যাঙের ছাতার মতো প্রতিদিনই গজাচ্ছে। বিশেষ করে অভিজাত পল্লী এলাকায়। মেয়েমানুষের দেহ বিক্রি ব্যবসার চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। শুধু এখানেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও। ঢাকা শহরেই শুধু নয়, সমস্ত বাংলাদেশের গ্রামেও এখন গেস্ট হাউজের এপিডেমিক। ছোট একটা রুম হলেই হলো। এর মধ্যেই যেনতেন প্রকারে একটা খাট ফেলে, দরজা-জানালা বন্ধ করে, কিছু পর্নো ম্যাগাজিন রেখে শুরু হয়, দেহ বিক্রির কায়কারবার। নাবালিকা, কচি যুবতী থেকে শুরু করে মধ্য বয়স্ক এবং বয়স্ক নারীরাও এই সস্তার কাজটি করে। কাজটা সস্তা, তবে মজুরি ভালো। সেখানে তো আগমন ঘটে ভিন্ন রুচির লোকদের। রুচি এবং চাহিদামাফিক সব বন্দোবস্তই রাখতে হয়। এমনকি সম বা উভকামিতাও। এক রাতে একশ, দু’শ, পাঁচশ’। খদ্দের বুঝে, বয়স ও শরীর বুঝে। গেস্ট হাউজ বন্ধ নয় বরং ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখার পক্ষের লোকেরাই বেশি। তার কারণ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এখন অসুখী পুরুষ। অসুখী কারণ, গেস্ট হাউজগুলোতে অন্য নারীর শরীরে এত সুখ যে, তার তুলনায় মাতৃত্বে ক্ষয়ে যাওয়া ঘরের বৌদের অতি ব্যবহারে জীর্ণ শরীর আর ভাল্লাগে না। এই সমস্যা কার নেই? মহামানব থেকে অস্পৃশ্য, সবারই। প্রেসিডেন্ট থেকে রিকশাওয়ালা। বুকে হাত দিয়ে বলুক–কার নেই। গেস্ট হাউজের যৌনকর্মীরা আমাকে গল্প শোনায়। গল্প শোনো মেয়ে। গয়না নয়, শাড়ি নয়। বাস্তবের গল্প শোন মেয়ে। আমি শুনি ওদের জীবনের গল্প। ওরা শোনায় আমারই চেনা, ভাই, চাচা, মামা, কাকাঁদের অন্যরকম গল্প। ঘর ভাঙছে। হৃদয় ভাঙছে। স্বপ্ন ভাঙছে। সঙ্গে গেস্ট হাউজের সংখ্যা আর পুরুষদের মিডলাইফ ক্রাইসিস, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দুঃখ শুধু মেয়েদের বেলাতেই এই ক্রাইসিসগুলো সমান সমান সত্ত্বেও, উপেক্ষিত, অবহেলিত।
২৮. স্বামী আসে স্বামী যায়
তখন বয়স আমার বারো বা তেরো। শেরপুরে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে রোববারের হাটের সব দোকান বসে। রবি আর বৃহস্পতিবারে সেখানে ধুম বাজার। বাজারের বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল সারিবাধা ছোট ছোট টিনের চালা দেয়া ঘর। এই চালার নিচে দিনের বেলা দোকানপাট, আবার বাজার শেষ হলে রাতের বেলায় এখানে শহরের ফকিরগুলো ওদের বোচকা-বুচকি নিয়ে এসে যার যার নির্দিষ্ট চালার তলায় গিয়ে বসে খুলতো ওদের সারাদিনের সগ্রহ ভাণ্ডার। বোচকার মধ্যেই ওদের তাবৎ সংসার। এর মধ্যে ওদের ছেঁড়া নোংরা পুরোনো গন্ধআলা কাঁথা, পুরোনো কাপড় চোপড়, কারো কারো হয়তো কৃচিৎ একটি ছেঁড়া মশারি। চারপাশে উন্মুক্ত পৃথিবী। আর তার একটুকরো চালার নিচে কুপি জ্বালিয়ে ওরা গল্প করতে করতে বিছানা পাততো। কেউ ধরতো গান। ভিক্ষের ভাগবাটোয়ারা বা জায়গা নিয়ে কেউ নিয়মিত ঝগড়া, এমনকি এই অন্ধকারেও ওরা মাথার উকুন পর্যন্ত বাছতো। কেউ কেউ বাজারের কুড়োনো ঝড়তি-পড়তি জিনিস বেছে, রান্না বসাতো। ওদের সঙ্গে, একটা দুটো করে পাটশোলা, শুকনো পাতা, ভাঙা খড়ির টুকরো আমিও আগুনে দিতাম। ফকিরগুলো এই চালার তলে গান আর ঝগড়ার কলরবে জাগিয়ে দিতো ভিন্ন এক ধরনের জীবন, যা সকালের আলোয় আর দেখা যেতো না। কৌতূহলী আমরা বোনেরা পড়া-শেষে সবাই দল বেঁধে যেতাম এই কলরব শুনতে। যা অন্যরকম, যা নিশ্চিত গোছানো নিরাপদ জীবনের উল্টো। যে জীবন আমাদের নয়।
তবে মধ্যরাতের পর এ জগৎ আলাদা হয়ে যেতো। এই চালার তলায় ফকিরনীদের জগতে শুরু হতো আর একরকমের জীবন। যেন সম্পূর্ণ আলাদা আর এক জগৎ। বৌয়ের বিছানা ফেলে শহরের পুরুষগুলো বের হয়ে ফকিরনীদের কাছে যেত। চালার তলা থেকে নিয়ে ওদের যেতো কখনো বটগাছের তলে, কখনো পুকুরপাড়, কখনো কোনও গলির ভেতরে।
আর এই চালার তলেই, কালু মিয়া আর হাফিজার পাশাপাশি জায়গা। দু’জনেরই মধ্যবয়স। কালু মিয়া একা। হাফিজাও। দিনের বেলায় দু’জনেই ভিক্ষে করে যার যার মতো। রাতের বেলায় ওদের শোবার নির্দিষ্ট জায়গা দুটো ঠিক পাশাপাশি। এক সপ্তাহের মধ্যেই পাশাপাশি শুয়ে থাকা কালু মিয়া আর হাফিজার মধ্যে প্রেম হলো।
একদিন শুনি, ওদের নাকি বিয়ে হয়ে গ্যাছে। পোলাও-মাংস খেয়েছে। খাইয়েছে। নতুন শাড়িও পরেছে। শুনেই গিয়ে দেখি, হাফিজা নতুন লাল শাড়ি পরে কালু মিয়ার মশারির তলায় শুয়ে। ওমা! কখন ওরা স্বামী-স্ত্রী হলো। তার মানে ওদের এক বিছানা। এখন থেকে হাফিজা রান্না করবে আর কালু মিয়া খাবে। এটা-ওটা দিয়ে যত্ন-আত্তি করবে। পায়ের নখ কেটে দেবে। এবং পাঁচ মাসের মধ্যে হাফিজার পেট ফুলে যায়। আট মাসে সে আর হেঁটে ভিক্ষে করতে পারে না। কালু মিয়া যা আনে তাই। পোয়াতি হাফিজাকে কালু আদর করে, বটগাছের তলে বসিয়ে রেখে নিজে.ভিক্ষে করতে যায়। হাফিজা আর হাঁটতেই পারে না। ওর চোখ ভাঙে। চেহারা ভাঙে। শরীর নরম হয়ে ঝুল ঝুলি করে। কয়েকদিন পর চালার তলেই সমস্ত রাত চিৎকার আর দাপড়ানোশেষে ওর একটা ছেলে হলো। ছেলের নাড়ি কাটা হলো বাঁশের কঞ্চি দিয়ে। নতুন কাপড় পরানো হলো। আমরা দিলাম জামা, খেলনা, কাজল। শখ করে ছেলের নাম রাখা হলো মুহব্বতজান কালু। আমার মনে পড়ে মা। মুহব্বতজানকে কোলে নিয়ে আদর করেছিলেন। দুধ কেনার জন্যে ক’টি টাকা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, বাচ্চার দিকে লক্ষ্য রাখিস। জঙ্গলে কিন্তু শিয়াল থাকে।