কৈশোর ও যৌবনের যাচিত ও অযাচিত সমস্যাগুলো মধ্য বয়সে এসে প্রথম ধরা পড়ে। মিডলাইফের জটিল ক্রাইসিস মানুষের বাকি জীবনকে নড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে নারীর জীবন। অতীতে তার মাতৃত্বের কারণে সকল শারীরিক, প্রাকৃতিক জটিলতা এবং বর্তমানের হরমোন পরিবর্তন, মেনোপজ, জরায়ুর শুষ্কতার কারণে করুণ। যৌনজীবন। সংসারে নারীর জীবন যেন বহুরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে একটি যন্ত্রের মতো। যৌবন গেছে। এবার মধ্য বয়সে এসে শুরু হয় সত্যিকারের ঝড় কাকে বলে। তার রুচি-অভ্যেস-ঘর-সংসার-হৃদয়-মন এবং মানসিকতা। নারী, এখানে পৌঁছে তার সবকিছু নিয়ে, নড়ে ওঠে।
০৩. মিডলাইফ ক্রাইসিসের রহস্য
ক. মিডলাইফ ক্রাইসিস নিয়ে আমার কেন এই কৌতূহল, সে নিয়ে অনেকেরই মনে প্রশ্ন। আবার কিছু কিছু ভুক্তভোগীরা বলছেন, বাহ! বেশতো, সাবজেক্টটা তো বেশ ভালো! যৌবন আর বার্ধক্যের সন্ধিক্ষণের এই যে একটা সময়, এখানে পৌঁছে মৃত্যুর। প্রথম অনুভব। একে কি অস্বীকার করা যায়! সুতরাং এটাই তো লেখার শ্রেষ্ঠ বিষয়। এবং খুব ভালো বিষয়। আমিও বলি! সেই তো! ওরাও বলে! অনেকেই বলে। এবং অবশেষে দেখি, সবাই বলে।
বয়ঃসন্ধি-কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ। এক অনন্য পরিবর্তন এবং অনুভূতি। বালক ও বালিকাদের বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তন, যা শাশ্বত। যা দৃশ্যমান। এই সময়ে তাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন লক্ষণীয়। প্রথমে ভাঙে তাদের কণ্ঠস্বর। নারী ও পুরুষের শারীরিক চিহ্নগুলোর পরিমিত বর্ধন হতে শুরু করে। মেয়েদের ঋতু, ছেলেদের বীর্যপাত ধরনের জটিল বিষয়গুলো যা হরমোনের সঙ্গে জড়িত, বয়ঃসন্ধিতেই হয় তার প্রথম প্রকাশ। শরীরে প্রথম এক অন্যরকম পুলকের অনুভব। রোমাঞ্চ আর অনুভূতি। আর এই রোমাঞ্চ থেকে শরীর অনুসন্ধানের কৌতূহল সবই সম্ভব হয় বয়ঃসন্ধিকালে। বয়ঃসন্ধি আনন্দের। বয়ঃসন্ধি বসন্তের। এই সন্ধি যৌবনের আগাম উৎসব। আমি তাকে বসন্ত বলি যেখানে যৌবনের কুঁড়ি ধরে, কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটে। রঙ লাগে। পাতা গজায়। যৌবনের প্রারম্ভে এই বয়ঃসন্ধি আমাদের যাচিত। নিজেকে ঘিরে এই মধুমাখা দুপ্রাপ্য সময় আমাদের বড় প্রাপ্তি। বয়ঃসন্ধির এমত কৌতূহল এবং ভালোলাগা খুবই কাম্য। কিন্তু তখন তা হয় গিয়ে যৌবন আর বার্ধক্যের বয়ঃসন্ধি! যেখানে পৌঁছে, যৌবনের সব জোয়ারে পড়ে ভাটা। সেটাও কি আমাদের কাম্য?
মিডলাইফ, সে-কি চিহ্ন, দুঃখের! সে-কি সুখের! সে-কী? কীসে? বার্ধক্যের প্রথম চিহ্ন দেখে আমরা কি ভয়ে চমকে উঠি না? মেয়েদের বেলায়, ঋতুতে অনিয়ম। যৌনাঙ্গে শুষ্কতা। হাঁটুতে ব্যথা, মেরুদণ্ডে ব্যথা। ব্যথা সর্বত্রই। ডাক্তার-ওষুধ, পথ্য। মাথায় পাকা চুল। দাঁতের মাঢ়িতে নেকলেসের মতো কালো কালো পাথর। পুঁজ, রক্ত, দুর্গন্ধ। দুই দাঁতের মধ্যে কালো অর্ধচন্দ্র গর্ত। ছেলেদের বেলায়, লিঙ্গ শিথিল হয়ে আসতে শুরু করে। রতিক্রিয়ার সময়ে পুরুষেরা ঠিক আগের মতো শক্তি পায় না। স্ত্রী, স্বামীকে দায়ী করে, কেন তুপ্তি হলো না। সুতরাং এত কিছু নিয়ে যে বয়স ও সময়টা জীবনে আসে, যৌবনের বিপরীত যা, তাকে নিয়ে লিখবো না তো কি নিয়ে লিখবো! তবে এখানেও ভাগাভাগির প্রশ্ন আছে। সমস্যা এই বয়সে কারটা বেশি! পুরুষ না নারীর। এর সোজাসাপটা উত্তর, নারীর। মেয়েদের মিডলাইফের সমস্যা অনেক অনেক গুণে বেশি। তার কারণ মেয়েদের রয়েছে সামাজিক সীমাবদ্ধতা। নারীর এত সীমাবদ্ধতা না থাকলে তার সমস্যাগুলো পুরুষের সমস্যার মতোই আবছা এবং অস্পষ্ট হতে পারতো।
প্রাপ্তি আর হারানোর এই বয়সে মেয়েদের সবচেয়ে বড় সমস্যা শরীরে তার হরমোনের পরিবর্তন। তার মাসিক ঋতু বন্ধ হয়ে যাওয়া। যাকে বলে মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি। ঋতুর পরিবর্তন, তার মনের ও চেহারার পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত। মেনোপজের শুরুতে বা মধ্যখানে অনেক মেয়ে, এমনকি আত্মহত্যা করার মতো মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে পারে। ঋতুবন্ধের আগে যেমন লাগতো, মন বা শরীর কোনওটাই ঋতু বন্ধের পরে তেমন লাগে না। ইংরেজিতে তাকে বলে ব্লু ফিলিং। বাংলায় নীল অনুভূতি। অনেক কিছুই তখন ভীষণ অন্য রকম মনে হয়। কেমন যেন ভালো না লাগার একটা সার্বক্ষণিক অনুভূতি। ভয়, না চাইলেও বার্ধক্য দুয়ারে এসে গ্যাছে। ওপরের ঠোঁটের দু’পাশে নাকের বাঁশি বরাবর মাংসের লম্বা দুটো ভাজ। আর নিচের ঠোঁটের দুই পাশের কোণার মাংসে দুটো ভাঁজের আগাম আলামত। মুখশ্রীতে কি বিশ্রী একটা পরিবর্তন! থুতনি, নাক সবকিছুই একটু নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। ভাঙে। নাক সংলগ্ন চোখের দু’কোণে জমে ওঠে ক্লান্তিজনিত কালো ছাপ। প্রস্তুতি নিতে থাকে। চোখ দুটো ভিতরের দিকে যাওয়ার। চেহারায় ম্লান হতে শুরু করে যৌবনের সৌন্দর্য। গাল দুটো ভারি হয়। একটু অতিরিক্ত মেদ, এখানে সেখানে সবখানে বিশেষ করে পেটে যাকে বলে নেয়াপাতি ভুড়ি। আয়নায় দাঁড়িয়ে মনে হবে–সত্যিই! এই ভঁজ কি সত্যি! এবং তা শত চেষ্টা সত্ত্বেও, মিথ্যে হয় না। সব মিলিয়ে বার্ধক্যের একটা ছাপ, চোখে পড়ার মতো। শিথিল হয়ে আসে শরীরের চামড়া। ত্বক হারায় তার লাবণ্য। মিডলাইফ, শরীরের ও মনের আরেক ধাপ আগাম পরিবর্তনের পুঞ্জীভূত মেঘবর্ষণের সময়সীমা।