লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, জাত, বয়স, সবাই সবকিছুর বিরুদ্ধে। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে। ক্রাইসিস, সৃষ্টি করে রেখেছে তার কোটি কোটি পা। মানুষ ইচ্ছে করে একটার বিরুদ্ধে আরেকটা দাঁড় করিয়ে তার বিরুদ্ধে নিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। যুদ্ধ তো আর কিছু নয়, শুধুই ক্লান্ত করবে। শুধুই শূন্যতায় ভরবে। অথচ সভ্যতা যখন ছিল না, তখন সমস্যাও ছিল পরিমিত। তাহলে দোষটা কার? সভ্যতার! আধুনিকতার! নাকি মূল্যবোধবিহীন মানুষের!
কটা টাকার জন্যে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেয়া শিশুকে টুকরো করে ফেরত দেয় সন্ত্রাসী। যুদ্ধে জয়ী হয় একপক্ষ, অপরপক্ষের কয়েক লক্ষ কফিনের বিনিময়ে। কৃষ্ণাঙ্গরা তাই ক্রীতদাস। অস্পৃশ্যরা তাই অমানুষ। দারিদ্র্য তাই ফকির-মিসকিন। নারী, পুরুষের চেয়ে নিচু। শুধু অন্যায় আর বৈষম্য। একজাতি আরেক জাতির বিরুদ্ধে। এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে। মানুষ, মানুষের বিরুদ্ধে। ক্যুনিজম গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। মানুষ ক্রাইসিসের সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে যেহেতু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষকে ব্যস্ত থাকতে হয়। নিষিদ্ধ ফলের ওপর আকর্ষণ বেশি। সমস্যা ভালো, সমাধান আমাদের পছন্দ নয়। ক্রাইসিস, একটা আনন্দ। একটা এন্টারটেইন্টমেন্ট। যেমন শাশুড়ি, বৌ পেটায়। বৌ শাশুড়িকে। স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে। এগুলো হলো গৃহস্থ-আনন্দ। দেশে দেশে, মহাবিশ্ব জুড়েই সর্বত্র সবকিছু, সবকিছুর বিরুদ্ধে, পরাজয়ের বিনিময়ে বিজয়ের আনন্দ করে। উল্লাস করে। নৃশংসতার বিনিময়ে একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয়। এক জাতির বিরুদ্ধে আরেক জাতি জয়ী হয়। মানুষের বিরুদ্ধে শাসক, শোষক হয়। মৃত্যু, রক্ত, অন্যায়ভাবে মানুষের আনন্দ হয়। মানুষের কষ্ট দেখে মানুষ সুখী হয় এবং একমাত্র মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব। কারণ আমরাই সবচেয়ে বড় অমানুষ!
তবে সব ক্রাইসিসকে ছাড়িয়ে আমার কাছে আজ যে ক্রাইসিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ক্রাইসিস। নিজের সঙ্গে দূরত্ব। নিজেকে বুঝতে না পারা। আমিত্ব থেকে বিচ্যুতি-বিচ্ছিন্নতা। মানুষের বিভ্রান্তির শুরু এখানে। জীবনের অপচয়ও এখানেই।
যৌবনের শুরুতে যা একরকম, মধ্য এবং বৃদ্ধ বয়সে তা অন্যরকম। মধ্য বয়স যা বয়সের সঙ্গে সময়ের বিষয়। প্রত্যেকের জীবনেই এই সত্য অমোঘ। না হলে মানুষ কেন একই চেহারায়, সৌন্দর্যে, গঠনে, আজীবন এক থাকে না! কৈশোরের রূপ কেন যৌবনে পাল্টে যায়। বার্ধক্যে কেন যৌবনের রূপ থাকে না! কেন মাথার চুল আজীবন কালো থাকে না। কেন মুখের চামড়া মুখ থেকে ঝুলে পড়ে! কেন বৃদ্ধ বয়সের দাঁতগুলো যৌবনের মুক্তো ঝরানো হাসি হাসে না!
স্বৈরাচারী শাসকের চেয়েও বড়, সময় বড় নিষ্ঠুর এবং ক্ষমাহীন। সময় হাত ধরে আমাদের নিয়ে যায় জন্ম মুহূর্ত থেকে মৃত্যুর দিকে। শৈশব থেকে বার্ধক্যে। ওষুধ দিয়ে মৃত্যুকে দেরি করানো যেতে পারে। কিন্তু সময় তাকে ফেরানো যাবে না। কিছুতেই না। বার্ধক্য–ঠেকানো যাবে না। সময় তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
সময়ের যাত্রাপথে মানুষের সব বয়সের সন্ধিক্ষণ মধ্য বয়স। মধ্য বয়স, প্রথম এবং শেষ জীবনের মধ্যিখানে। কি সুন্দর একটি মিলনক্ষেত্র! মিলনক্ষেত্র, যখন আমাদের যৌবনকে আমরা জানাচ্ছি বিদায় আর বার্ধক্যকে জানাই অভিবাদন। যা জানাতে আমরা বাধ্য। কোনও বিত্ত বা ক্ষমতা একে রোধ করতে পারে না। মধ্য বয়স, জীবন নামে একটি মহাসমুদ্রের একেবারে মাঝখানে, যেখানে এসে জোয়ার এবং ভাটা কিংবা বলা যেতে পারে যোগ আর বিয়োগ মিলে, (+ -) = বিয়োগ। এবং এই বিন্দুতে পৌঁছে জীবনের মহাসমুদ্র, একটা নিরঙ্কুশ শূন্যতা, অর্থাৎ সাব-জিরো, যেখানে পৌঁছে মানুষ প্রথম খুঁজে পায় বিচ্ছিন্নতা, যৌবনের সাথে। যোগাযোগ অনুভব করে বার্ধক্যের সাথে। এই মহাসমুদ্রে তখন সে একা তার একমাত্র সঙ্গী হতে পারে তার ‘আমিত্ব’। কিন্তু এই আমিত্বকে যে চিনতে ভুল করে সেখানেই তার সর্বনাশের শুরু। আর যে চিনতে পারে, ধরতে পারে তার জীবনের আরো বহু খোলা জানালা এখানেই খুলে যাবে।
মানুষের মিডলাইফ যেমন আছে। মিডলাইফের ক্রাইসিসও তেমন আছে। একদিকে বিচ্ছেদের বেদনা। অন্যদিকে প্রাপ্তির। এই বিচ্ছেদ এই প্রাপ্তি কোনওটাই আমাদের কাম্য নয়। এই মহাসমুদ্র, ভীষণ অচেনা। কৈশোর-যৌবনের সোনালি সময় ফেলে কে যেতে চায় বার্ধক্যে! কে চায় মৃত্যুর হাতছানি! এই যে সন্ধিক্ষণ, জীবনের সঙ্গে সময়ের, মন ও অনুভবের, গ্রন্থির সঙ্গে হরমোনের! এই সময়ে অনেক রকম জটিলতার সৃষ্টি হয় মানুষের মনের ভেতরে। মেয়েদের মেনোপজ বা ঋতুর শেষ কয়েক বছর আর পুরুষের শুক্রাণুতে ভাটার সময়। উভয়েরই দুটো মূল্যবান সম্পদ জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার মতো দুঃসংবাদ। ফলে মেয়েদের শরীরের গোপন জায়গা হয়ে ওঠে শুষ্ক, আর ছেলেদের বেলায় শৈথিল্য। এই সময়ে পৌঁছে নারী ও পুরুষ উভয়েরই শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, স্বাভাবিক ও সর্বজনীন। এর কারণ, সময়। সময়, যা একই সঙ্গে নিষ্ঠুর এবং ক্ষমাহীন।
যৌবনের অনেক নিষ্পাপ ভুল এখানে এসে প্রথম ধরা পড়ে। মিডলাইফ ক্রাইসিস, অতীতের পুঞ্জীভূত মেঘ, মেঘ যা অতীত জীবনের আকাশে শুধু স্তরে স্তরে জমেই গ্যাছে একটার পর একটা বছরের পৃষ্ঠে বছর ধরে, কোনওরকম বর্ষণ ছাড়াই। মধ্য বয়স, সেখানে পৌঁছে জীবনের আকাশ প্রথম কেঁপে ওঠে ঝড় আর বিদ্যুতের চমকানিতে। তারপর আসে বর্ষণ আর উতল হাওয়া। শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। ঝড় একটু করে কমে, আকাশের মেঘ একটু একটু করে পরিষ্কার হয়। অতীত, পরিচ্ছন্ন আকাশে তাকিয়ে নতুন করে প্রথমবারের মতো ফিরে দেখা যায়। যেখানে দেখা যায় যৌবনের সব পুঞ্জীভূত নিষ্পাপ কিংবা ইচ্ছাকৃত ভুল। একটার পর একটা। ভুল যা মনে হয়, না হলেও পারতো। না চাইলেও, করা হয়ে গ্যাছে। হয়ে গ্যাছে যা, অতীতে। অতীত যা এখন মৃত। যা এখন মৃত বলে দূরে এবং দূর বলে দূর থেকে যা আরো স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া যায়। দেখতে পাওয়া যায় তাকে, যাকে ঘটনার এত কাছে বলে অতীতে কখনোই মনে হয়নি, যে এগুলো ভুল বা এগুলো অপচয়। মধ্য বয়স, সেই অনুভূতিগুলো উপলব্ধির প্রথম বয়স। মধ্য বয়স, জীবনের সবচেয়ে সত্য, বাস্তব ও সুন্দর সময়।