এই যে বেঁচে আছি! বড়ই অবাক লাগে। বেঁচে আছি শোষণের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাস, ক্ষুধা, যুদ্ধ, অসুখ-বিসুখ, স্বৈরাচারী আচার-আচরণ, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নিষ্ঠুরতা, চাহিদা, অস্থিরতা, ভগ্নহৃদয়, ব্যর্থ প্রেম …। প্রতিটি মুহূর্তেই সঙ্কট। যে কোনও কিছু ঘটে যেতে পারে। সামান্য কারণে মৃত্যু পর্যন্ত। একটু পা পিছলে পড়লেই মৃত্যু। একটা সংক্রামক ভাইরাস। একটা চলন্ত গাড়ির চাকা। রাস্তার হিংস্র কুকুর। সন্ত্রাসীর উড়ন্ত বুলেট। তবু বেঁচে থাকি দুর্ঘটনার মতো। মৃত্যুর কাছে আমাদের এই ক্ষুদ্রতা আমরা বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু না বুঝলেও তাকেই অতিক্রম করার যুদ্ধ। তাকে অস্বীকার করি বলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারি। না হলে পারতাম না। ফলে শাসন-শোষণ, যুদ্ধের কারণে মানুষের এত যে অহেতুক মৃত্যু, এই অস্বীকারের ব্যাখ্যাও কিন্তু ঐ ক্রাইসিসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তবে মৃত্যু কাউকে ক্ষমা করে না। না শাসক, না শোষক কাউকে না। জীবনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য যাকে আমরা প্রতিনিয়তই ভুলে যাই তা হলো–”জীবনের কাছে মৃত্যুকে আমরা ঋণ করেছি।” যার অর্থ মৃত্যু দিয়েই একদিন, জীবনের কাছে আমাদের যাবতীয় দায়-দেনা পরিশোধ করতে হবে। করতেই হবে। কেবল সেখানেই কোনও ক্ষমা-ঘেন্নার অবকাশ নেই।
একটি শিশুর জন্ম। যম আর মানুষ। মা ও শিশুর বিপন্ন জীবন। মৃত্যুর আগাম শঙ্কা নিয়ে এভাবেই আমাদের জীবনের শুরু। এবং তারপর থেকে মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনে, প্রতিটি দিন মানুষ যেন বেঁচে থাকে তার জন্মের উত্তর দিতে দিতে, কেননা মানুষ জন্মই একটা বিশাল প্রশ্নমালা। কেন বেঁচে আছি! কি জন্যে! নশ্বর জীবন ঘিরে বড় বড় প্রশ্নমালা। মন্বন্তরের হা-ভাতেদের মতো হাত পেতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে! আর আমরা, তারই মধ্যে অপরিসীম আনন্দ ও যন্ত্রণায়-সরবে নীরবে, সুখে-দুঃখে জীবনযাপন করে যাই মাত্র কয়েক দশকের জন্যে মাপা যে জীবন, সেই জীবনকে, গোপনে গোপনে মৃত্যুর প্রস্তুতিতে।
আমরা ভাবতেই পারি, এত সব ক্রাইসিস এই বুঝি একটা সমাধানের মধ্য দিয়ে শেষ হতে চলছে। কত আশা আমাদের! অপেক্ষাই সার। একটি শেষ হচ্ছে আর একটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মেয়ে বড় হয়েছে। ছেলে পাস করেছে। নিজের ব্লাডপ্রেসার। ওষুধ। ডাক্তার। চেষ্টা, একটার পর একটা। বিয়ে হয়, চাকরি হয়, ডাক্তার হয়। বিয়ে হলে বাচ্চা হবে। চাকরি হলে বাড়ি-গাড়ি হবে। ব্লাডপ্রেসার কমলে তাকে সারাজীবন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্রাইসিসগুলো ভাইরাসের জীবাণুর মতো কেবলই বাড়তে থাকে শতক, সহস্র, অযুত-নিযুত আর কোটিতে।
সমস্ত জীবন ধরে এত এত জবাবদিহিতা। ব্যাংকের হিসেবের বইয়ে কোটি কোটি টাকা। বাড়ির গোটা বিশেক দলিল। বিশালাকারের সংসার। মাটির তলায় লুকিয়ে রাখা ঋণ খেলাপির অর্থ। ”আমাদের ক্ষুদ্রতা” মৃত্যুর হাত ধরে আরও ক্ষুদ্রতর হওয়া। অবশেষে একদিন লক্ষ্মী ছেলের মতো শোষক এবং শাসক দু’জনকেই, মৃত্যুর হাত ধরে চলে যেতে হয় সব ছেড়েছুঁড়ে। আর আমাদের ফেলে যাওয়া ক্রাইসিসগুলোকে ঘিরে। নতুন নতুন সব সমস্যার সৃষ্টি হয়। রেখে যাওয়া সম্পত্তি কে খাবে! কতটা খাবে! নির্ভর করে পেট কার কতটা বড়। কত বড় ক্ষুধা। ক্রাইসিস আমাদের চলে যাওয়ার পর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যায় নবায়ন হয়ে।
এই যে এতো বড় বড় ঝড় আমরা কাটিয়ে উঠি! ক্যান্সারের মতো অসুখ! সন্তানের অকাল মৃত্যু। নিজের অকাল বৈধব্য। মনে হয় এরপর কি আর অন্ন খাবো? ঘুমোবো? বাঁচবো? তখন মনে হয় জীবন কত তুচ্ছ। এরপর সব-সব ছেড়ে দেবো। দিয়ে শুধু পরকালের কথা ভাববো। কিন্তু ক্রাইসিস কমলে, আমরা কি ঠিক আগের মতো গল্প করি, খাই-দাই, ঘুমোই, সিনেমা দেখি, শরীর খেলি। আমরা কি সন্তানের মৃত্যু-শোক কুলিয়ে ওঠা শেষ হলে, সত্যিই বিত্তের ভাবনাগুলো ছেড়ে দিই? গাড়িতে চড়ি না? ঘুমোই না! খাই-না! ক্যান্সার সত্ত্বেও কি সত্যিই ব্যাংকের ঋণ করা টাকা মেরে দিয়ে স্বেচ্ছায় দেউলিয়া হওয়া থেকে বিরত থাকি? হজ শেষের সব প্রতিজ্ঞাই কি রাখি? রাখলে যে পরিমাণ হাজী এই বাংলাদেশে রয়েছে শুধু তারাও যদি অন্তত তাদের প্রতিজ্ঞা পালন করে দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে পারতো তাহলে গোটা দেশের চেহারাটাই পাল্টে যেত। মনে রাখা প্রয়োজন, মুসলিমপ্রধান দেশের অধিকাংশ শাসকই ধর্মপ্রাণ হাজী। অথচ সেসব দেশেইতো দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি। সুতরাং আমার হিসেবে মেলে না কিছুই, কিছুতেই।
ক্রাইসিস কোথায় নেই। বেডরুম-লিভিংরুম, সেক্রেটারিয়েট, রমনা পার্ক, সংসদ, সংবিধান, গাঁজা স্ট্রিপ, শাঁখারিবাজার, পার্ক সার্কাস, কাবুল, ওয়াশিংটন, সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগরের উপকূল, প্রতারক প্রেমিক, নিষ্ঠুর স্বামী, গার্মেন্টসের বিষ, জনসংখ্যা, বাতাসে কার্বন, ভেজাল খাবার, নার্সিং হোম আর হাসপাতালের অপারেটিং রুম, ক্রাইসিস কোথায় নেই? যা খাচ্ছি, যা পরছি, যা দেখছি, যা অনুভব করছি। বেঁচে থাকাটাই দুর্ঘটনা। মৃত্যু, সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে। পায়ের নিচে পড়লে সব পিঁপড়েই মরে না। কিন্তু ছ’তলা থেকে পা পিছলে পড়লে যে-কোনও মানুষের মৃত্যু সুনিশ্চিত। সুতরাং এত প্রতিকূল কিছুর মধ্যেও যে বেঁচে আছি এটাই মিরাকল। জীবন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো গগনচুম্বী। জীবন আবার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো একটা খেলনা, একটা ঠুনকো হালকা চুড়িও। কয়েক সেকেন্ডেই ধসে যায়। কারণ যত শক্তিশালীই হোক, মৃত্যুর কাছে তা কাগজের চেয়েও-নরম।