হৃদয়ের ব্যাপারগুলোকে বৈধ কিংবা অবৈধ বিশেষণে বিশেষিত করাটা ভুল। এর একটি নিজস্ব জগৎ আছে, যেখানে কোনও রকম যুক্তি-তর্ক-নিয়ম কিছুই কাজ করে না।
প্রেম, সুন্দর। মধুময়। প্রেম, জীবনের উৎস। প্রেম, চিরন্তন। আর কাম হলো তার প্রকাশ। একে অপরের উৎস এবং সম্পূরক। প্রেম পরিপূর্ণতা পায় কামের জোয়ারে। কামবিহীন প্রেম কি প্রেমবিহীন কাম যা অসম্ভব! যেমন অন্ধের দুই চোখ। দিব্যি সুন্দর দুটো চোখ স্নায়ুর অভাবে, দৃষ্টিবিহীন। প্রেমবিহীন শরীর আর স্নায়ুবিহীন চোখ, এক।
প্রেম, হোক না তা পরকীয়া, তবুও তারই জয়জয়কার। তার সৌন্দর্যের। ব্যক্তিগত চরিত্র বিশ্লেষণ সেসব অন্য বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব অন্যদের। আমি শুধু বুঝি মানুষের জীবনে তার অনিন্দ্যসুন্দর উপস্থিতি, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। যা মানুষকে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়।
০২. ক্রাইসিসপূর্ণ জীবন
চোখ খুলে তাকালেই দেখতে পাই, চারদিকে সঙ্কট আর সঙ্কট। মানুষের জীবনে এর কি কোনও শেষ আছে? আসলে মানুষের জীবন মস্ত এক যুদ্ধক্ষেত্র। আর এই যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনের নানাবিধ সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতেই যেন মানুষের জন্ম এবং মৃত্যু। প্রতিদিন কত রকমের সমস্যা আমাদের জীবনকে ঘিরে থাকে। এই যে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা-নাশতা। খেতেই হবে। না খেলে পেটে ক্ষুধায় তীব্র যন্ত্রণা হবে। কিছু না খেলে এই যে চলে না, এই যুদ্ধ দিয়েই আমাদের দিনের শুরু। এরপর দিনের প্রহর যত গড়িয়ে যায় প্রহরের সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে সমস্যা আর সমস্যা।
প্রতিটি চলার মুহূর্তই মানুষের জীবনে, সমস্যার মুখোমুখি হওয়া। আর মোকাবিলা করতে করতে বেঁচে থাকা। যেমন ধরুন একজন ক্যান্সারের রোগী। সেও বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার কি তীব্র বাসনা তার! সেজন্যই কি সে কেমো-রেডিয়েশন নিচ্ছে না! কিন্তু ওদিকে মৃত্যু নিয়ত তাকে ছোবল দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। এই যে বেঁচে থাকার লড়াই জীবন আর মৃত্যুর সঙ্গে, একে কি বলবো? তবে অনেক সময় মানুষ তার সমস্যাগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে না ধরতে পারে, না পারে বুঝতে। তবুও মানুষ, বোঝা না বোঝার ভান করে করেই বেঁচে থাকে।
মানুষের চাওয়ার যেমন অন্ত নেই। ক্রাইসিসেরও তেমনই শেষ নেই। মানুষের চাওয়া-পাওয়া অফুরন্ত বলে ক্রাইসিসও ফুরোয় না। চেয়ে চেয়ে কাঙাল হয়ে বেঁচে থাকা। কত দুঃখ আর মৃত্যুর মতো সত্য প্রতিদিন আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। কিন্তু এই অপরিমিত চাওয়ার ভারে মানুষ ক্লান্ত হয় না। যা পায় না, তারই জন্যে সীমাহীন লোভ। যা পেলো তার প্রতি অবহেলা। এই করে করে মানুষ অর্থহীন জীবনটাকে অর্থবহ করে তোলার উন্মত্ত নেশায় মত্ত। কত কিছুইতো আমাদের চাই। না চাইলে লাগে না। পেলে আরো চাই। আরো পেলে, আরো আরো চাই। আমাদের পেটটা যেন ভগবানের অপরিমিত ক্ষুধার দান। একদিকে যেমন দিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তেমন খেয়েই চলছে। খেয়ে খেয়ে তার ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না। এমনকি তার খাওয়ার ছুতো করে সেগুলো আবার আমরাই খাই। আসলে এই ক্ষুধাটা কার? আমাদের না ভগবানের? ভগবান তো একটা অজুহাত। তেমনি অজুহাত সন্তানের। অজুহাত সংসারের। অজুহাত নিজের। সবার জন্যেই কিছু না কিছু চাই। ভাত থাকলে সঙ্গে ডাল। ডাল থাকলে সবজি। সবজি থাকলে চাই মাছ, চাই মাংস। আর সব থাকলে চাই, যা নেই। ভিখিরিদের চাই শুধু ভাত। না পেলে ভিক্ষে। ভিক্ষে না মিললে, চুরি। শুধু এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন চাই। দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরের সময় সে চাওয়া আবার ফ্যানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হতে পারে।
আমাদের চাওয়ার কোনও শেষ নেই। লাগাম নেই। কোনও লজ্জাবোধও নেই। দুঃখ থাকলে সুখ। সুখ হলে দুঃখ। ঘুম এলে যে-কোনও জায়গায় একটি বালিশ পেতে ঘুমোলেই চলে। কিন্তু ঘুমের জন্যে আমাদের চাই রুম। রুম হলে, বেডরুম। বেডরুম হলে, মাস্টার বেডরুম। মাস্টার বেডরুম হলে …। অথচ শোবার একটু জায়গা, একটু ঘুম, এইটুকু হলেই কিন্তু শোয়া যায়। যেমন রাস্তায় অসংখ্য ভাসমান মানুষেরা ঘুমোয়। যেমন মুটে-মজুর, কুলি-রিকশাওয়ালা-টোকাইরা ঘুমোয়। অথচ পাশেই কি বিশাল ইমারতে কেউ হয়তো মাথা খুঁড়ে মরবে সামান্য একটু ঘুমের আশায়! ওষুধ খেয়েও ঘুম আসছে না। তা সে দালান-কোঠা, ফুটপাত যেখানেই হোক না কেন ঘুম, দু’জনেরই কিন্তু এক। পাঁচ হাজার টাকা বেতনেও সংসার চলে। আবার পাঁচ লক্ষেও। কিন্তু কখনো কখনো আমাদের পাঁচ কোটিতেও কুলোয় না। ক্রাইসিস লেগেই থাকে। কত। খাদ্য চাই! কত বিত্ত! ক’জোড়া জুতো! কটা গাড়ি, বাড়ি! ক’খানা কম্পিউটার সেলফোন! যখন সেসব ছিল না তখন দিন যায়নি! ব্রোঞ্জ-প্রস্তর-লৌহ যুগ, যায়নি! গ্যাছে, তখনও দিন গ্যাছে কিন্তু এখন যায় না। যায় না কারণ এখন যত আছে, আমাদের চাহিদাগুলো তার চেয়ে বেশি ক্ষমাহীন, সীমাহীন। “সীমাহীন লোভের কারণে সৃষ্ট চাহিদাগুলোই রূপ নেয় ক্রাইসিসে।” যেন বিপুল পরিমাণ বিত্ত, খাদ্য, পোশাক, প্রাসাদও আমাদের যথেষ্ট নয়। যদি হতো, তাহলে-পৃথিবীর সব পুঁজিবাদ বন্ধ হয়ে যেত। পুঁজিবাদ যা সৃষ্টি করে কৃত্রিম অভাব। অভাব নেই, তবুও। অভাব বাজারের। যেখানে ওরা বিক্রি করবে। মানুষ কিনছে একটার জায়গায় তিনটে। কিনে ফেলে রাখছে। পুরোনো হলে-গার্বেজে ফেলছে। কখনো কখনো আমরা পুঁজিবাদের এই কৃত্রিম ক্রাইসিসেরও শিকার। আমরা বলতে যারা গৃহী এবং গেরস্ত। যারা গৃহস্থ, তাদের ক্ষেত্র সংসার। সংসার হলো, সংসার চাহিদা এবং ক্রাইসিসের ভ্রূণ নিষিক্তের প্রসূতিকাগার।