বাড়িতে তুমি আমি দু’জনেই গম্ভীর। এই গাম্ভীর্যের ভাবখানা এরকম যে তুমি আমাকে বলছো সব দোষ আমার। আর আমি বলছি তোমার। চোখ দিয়ে ঘৃণা আর শাসন করা এবং তখনকার জন্যে এটাই ছিল বরং সবচেয়ে সহজ কাজ। কেননা দোষ দিয়ে নিজের অন্যায় অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারলে ভালো লাগে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকলো তোমার ভালোমানুষি পুরুষের আস্তিনের তলায় ছদ্মবেশী এক রক্ষণশীল স্বভাবের পুরুষের প্রকৃত চেহারা। এই চেহারা, যা পুরুষের শাশ্বত রূপ। যা আমার সংসারে নবাগত।
জেনেছিলাম–সাদা, কালোর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। স্বৈরাচার, গণতন্ত্রের চেয়ে। সবল, দুর্বলের চেয়ে। সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘুর চেয়ে পুরুষ নারীর চেয়ে। তুমিও দিন যত যায়, বোঝালে সংসারে পুরুষ নারীর চেয়ে বড়। কি করে বুঝলাম! বুঝাবার যথেষ্ট কারণ তুমি দেখিয়েছ। ক’টা বলবো! তবে সবচেয়ে বেশি বুঝলাম, যেদিন দেশ থেকে আমার ছোট বোনটার বিয়ের খবর এলো। রমা লুকিয়ে বিয়ে করেছে এক মুসলিম ছেলেকে। ছেলেটিকে আমি চিনতাম। অনেক নিষেধ সত্ত্বেও এই ভয়ই সত্য হলো। রমার ব্যাপারটা, তুমিও জানতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সঙ্গে সঙ্গে তুমি বললে, রমা একটা নষ্টা। একটা জারজ। ও যেন এখানে কখনো যোগাযোগ না করে। বললাম, কি বলছো এসব! বিদেশে তুমি তাহলে কাঁদের সঙ্গে থাকছো, কাজ করছো! ভিন জাতের বাড়িতে নেমন্তন্ন খাচ্ছে। অথচ সব দোষ হয়ে গেল রমার! জানি না হিন্দু আর খ্রিষ্টানের বিয়ের সঙ্গে কি তফাত হিন্দু-মুসলিমের।
যখন প্রয়োজন তোমার সমবেদনা, তখন তুমি দেখালে ঘৃণা। তুমি জেদ ধরে বসলে যে, আমি আমার নষ্ট জারজ পরিবারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখতে পারবো না। রমার এই সংবাদে, বাড়িতে শোকের ছায়া। যেন কেউ মারা গেছে। এই সংবাদটি ফোন করে জানালো বিল্ট, আমার ছোট ভাই। বললো গ্রামে ভীষণ হৈ-চৈ হচ্ছে। লোকজন বাড়িতে এসে হট্টগোল করছে। বাবাকে অপমান করছে। বাবার হার্ট এ্যাটাক হয়ে সে হাসপাতালে, প্রায় মৃত্যুমুখে। অপারেশনের জন্য টাকা লাগবে, প্রায় দু’লক্ষ। তোমার ভয়ে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। কি করি! কি করা যায়। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করি, লুকিয়ে। টাকা পাঠালাম, লুকিয়ে। বুঝতে পেরে, আমাকে ভীষণ গালাগাল করলে। অন্যদিন, ধরে মারলে। তোমার এই মনুষ্যত্বহীনতা আমাকে–উভয় সঙ্কটে ফেলে দেয়। এ কথা কাউকে না পারি বলতে, না পারি গিলতে। এতকাল পুরুষের দানব চরিত্রের যেসব কাহিনী শুনে এসেছি, সে জিনিস এখন সত্য হলো আমারই কপালে!
রমার ব্যাপারে তোমার সিদ্ধান্তে তুমি রইলে অটল এবং ক্ষমাহীন। দুজনের মধ্যে একরাশ নীরবতা আমাদের ঘরটাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে। তা সত্ত্বেও –বছরখানেক পর, মুহূর্তের আবেগে কি যেন ঘটে গেল! ফের আমার পেটে বাচ্চা এলো। বাচ্চাটা পেটে এসে বিপদ আবার নতুন করে বাড়লো। মনে শান্তি নেই। মনে হয় পঙ্গু বাবার কথা। সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুধু রমা রমা করেন। রমা-তুই, কি করলি! বলেন, আর কেঁদে-কেটে বুক ভাসান। আমাদের সমাজ। যেখানে মানুষের মন ক্ষমাহীন, নিচু। মর্ত্যের নরক। রমাকে নিয়ে সামাজিক গণ্ডগোল তুঙ্গে। মানুষের অত্যাচারে বাড়ির ওরা ভারতে চলে যাবেন বলে ভাবছেন। অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। মা বললেন, তুই একবার আয়। দেশে তোর আসাটা খুবই জরুরি। পাড়ায় একটা মীমাংসারও ব্যাপার আছে। তাছাড়া, হিন্দু-মুসলিমের বিষয় নিয়ে যে নোংরামো এবং কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে, মার বিশ্বাস এতে করে ওদেরকে হয়তো সব সম্পত্তি বিনে পয়সায় দিয়ে, ভারতে চলে যেতে হবে। পড়শিদের দু’একজন এই সুযোগে আমাদের বাড়িঘর দখলের ষড়যন্ত্র করছে বলে মা জানালেন। সুতরাং বুঝতেই পার আমার যাওয়াটা, কতটা জরুরি। কিন্তু পেটের বাচ্চার অজুহাত দেখিয়ে তুমি যেতে দিলেই না। বাবা মৃত্যুপথে। তুমি সেটা বুঝলে না। তবে ডাক্তারেরও নিষেধ ছিল বলে সেদিন আমিও জোর করিনি।
আমি ছোটবেলা থেকেই সময়ে বিশ্বাসী। সময়ই সব ক্ষত শুকিয়ে দিতে পারে। আমি অপেক্ষায় রইলাম। এরপরে প্রিতু হলো। বাবা মারা গেলেন। রমার জীবনটা আস্ত নরক হলো। আমিও অপারক। তা সত্ত্বেও প্রিতুর কথা ভেবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে বিরত রইলাম। তুমি কাজে চলে যাও সকালে। আমি বেলা অবধি মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে। তখন আমি মা। আমার অন্য আরেকটা কাজের জায়গা, দু’ দুটো কম্পুটার, দুটা টেলিফোন, বছরে চল্লিশ হাজার ডলার বেতন সবই অন্যের দখলে। ড্রাইভওয়েতে আমার নতুন গাড়িটা বেকার সময় কাটায়। রাত জাগা আমি দিনে ঘুমোই। মেয়ের মুখে তুলে দিই স্তনের বোটা। অনবরত স্তনের এই দুর্দশা, আমাকে মাতৃত্ব বিষয়ে বিশ্রী অনুভূতি দেয়। স্বাভাবিক কর্মজীবন থেকে এই বিচ্যুতি আমাকে প্রবল ক্রোধের দ্বারস্থ করে তোলে। বাচ্চা হওয়ার পর নীল অনুভূতি আমাকে ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে, হতাশায়। মাতৃত্ব আমাকে নরক যন্ত্রণা দিতে শুরু করে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হতো, দু’হাতে প্রিতুর গলা টিপে মেরে ফেলি। কারণ ওর জন্যই তো আমার এই বন্দি জীবন। না হলে বাবাকে দেখতে পেতাম। প্রিতুকে একদিন গলা টিপে প্রায় মেরেই ফেলেছিলাম। তুমি বাড়ি ছিলে না বলে টের পাওনি। ও খুব কেঁদেছিল। তুমি শুধু বললে, ও এত কাঁদছে কেন? বলেছিলাম, খিদে পেয়েছে তাই। আজ বলতে বাধা নেই, প্রিতু, সেদিন প্রায় মরেই গিয়েছিল।