সেই জটিল, সেই নরক থেকে সরে এসে এখন আমি যে জায়গাটায় বসে আছি, প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা এই জায়গাটায় অনেক সবুজ ঘাস। ঘাসের ওপরে ধুয়ে যাওয়া বৃষ্টির জল। সবখানেই কাদা। অন্ধকারে দূর থেকে দু’একটা ব্যাঙের ডাক শোনা। যায়। কিছু দূরে অনেকগুলো ছোট বড় গাছের আভাস, নদীর গতিকে বুঝিয়ে দিতে। ঝিঁঝি পোকাগুলো করাত দিয়ে কাটছে বর্ষার অন্ধকার রাত। ঐ দূরে একটি আগুনের শিখা। অনবরত জ্বলছে। জানতাম, ঐখানেই কোথাও হবে, ব্রহ্মপুত্রের পারে, বহু পুরোনো একটা আদি শ্মশান। শ্মশান, যার নাম শুনলে আগে ভয়ে কাঁপতাম। আজ সেসব অতিরিক্ত ভয়গুলো আমার আর নেই। কারণ যে নরক দেখেছে, শ্মশানে মরা পোড়ানোর নিষ্ঠুরতা তার কাছে অনেক কম যন্ত্রণাদায়ক। আর আমি সেই নরক তোমার মধ্যে দেখে দেখে শুশানের ভয় থেকে মুক্তি পেয়েছি।
তবুও বিশ্ব নামের এত বড় বিশাল সংসার থেকে মুক্তি, বন্ধন ছিন্নতা সহজ কর্ম নয়। আপন সংসারের যে মায়া, যে মাধুর্য, সেখান থেকে শেকল কাটাও সহজ নয়। সংসার একটি দৈত্যসুলভ সর্বনেশে মায়া ও বন্ধনের সমুদ্র। এখানে অক্টোপাসের আটটির বদলে ষোলটি বাহু। আর সে তার বাহুগুলোতে আমাকে সংসার সন্তানের মায়া মরীচিকা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি করে রেখেছিল। কিন্তু আমার ওপর তোমার অন্যায় অবিচার এত মাত্রাহীন হয়ে উঠলো যে বোধ একদিন আমাকে তাড়া করলো। আর সেজন্যেই আজ আমি এই জায়গায় পৌঁছুতে পেরেছি। তা সত্ত্বেও প্রিতুর কারণে সেখান থেকে উত্তরণ ঘটতে ঘটতে চলে গেল জীবনের অনেকটা সময়। জীবনটা যে এত দ্রুত এরকম বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো নড়বড়ে হয়ে যাবে সে আমি একেবারেই যে বুঝিনি তা ঠিক নয়, তবে ভেবেছিলাম হয়তো বর্ষণ হয়ে একদিন ঝরে যাবে আমাদের মধ্যেকার দুর্যোগের এই মেঘ। কিন্তু সময় যত যায় ততই দেখি দুর্যোগ, নৌকোভর্তি মেঘ ঢেলে দিয়ে দ্রুত চলে যায়, শুধু ফিরে আসতে আরো দুর্যোগে ভেজা মেঘ সঙ্গে করে নিয়ে।
আমি জানি, মৃণাল ও আমার সময়, জীবনযাত্রা, পরিস্থিতি এক নয়। তবে মুক্তির পথ, এক। গৃহহীন হয়ে ফিরে যাওয়া প্রকৃতির কাছে, যেখান থেকে আমরা এসেছি। জলে, সমুদুরে। আমাদের দেহের শতকরা আশি ভাগই তো জল দিয়ে তৈরি। তাই এই ব্রহ্মপুত্রের বিশালতার কাছে আমার ক্ষুদ্রতা ধুয়ে নিজেকে ফিরে পেতে, এখানে ফিরে এসেছি আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে। এসে প্রতিদিনই নিজেকে চিনতে চেয়েছি, ক্ষুদ্রতা ধুয়ে। আজ মনে হচ্ছে এখনই সময়। এই দশ বছর সময় আমার জীবনে একটি হিমালয়ের মতো এতই বিস্ময়কর পাহাড়, যার জঙ্গলে বসে আমি নিজেকে খুঁজে নিয়েছি। তবুও অতীতের সেই সংসারের কত স্মৃতিই তো মনে পড়ে! মনে পড়ে সুন্দর এক যুবকের কথা, যে ছিল আমার হৃদয়ের মধ্যমণি। মনে পড়ে বিয়ের পরপর সংসার নিয়ে আমার রোমাঞ্চের কথা। কাজের পর বাড়ি ফেরার জন্যে মনটা চঞ্চল হয়ে থাকতো। কাজশেষে বাড়ি ফিরে রান্না করবো, একসঙ্গে খাবো। বিছানায় শুয়ে তোমার সঙ্গে গল্প করবো গভীর রাত অবধি। তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে একটি শিশুর মতো অবুঝ হয়ে ভুলেই যাবো আমি কে। তোমার বুকের ওম আমার শরীরে জাগাবে, ভালোবাসা। যেন একটা নেশায় পেয়ে বসলো।
বিয়ের পাঁচ বছর অবধি, তোমার মধ্যে আমি অন্যান্য পুরুষের মতো হীনমন্যতা দেখিনি। বরং তুমি আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে সাংসারিক বিভিন্ন জটিলতার সময়ে আমার পক্ষেই কথা বলেছ। কিন্তু বিদেশে আসার প্রায় সাত বছর পর হঠাৎ যেন। তোমার মধ্যে কি ঘটে গেল। অদ্ভুত এক পরিবর্তন দেখলাম যখন বহু প্রতীক্ষার পর প্রথম সন্তানটি পেটে এলো। তুমি বললে বাচ্চা হয়ে গেলে কাজ ছেড়ে বাসায় বাচ্চা মানুষ করতে হবে। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। একি কথা শুনছি তোমার মুখে! যেন এক অন্য তুমি! মাতৃত্ব ভালো, কিন্তু মাতৃত্ব যে অভিশাপও হতে পারে সেইদিনই প্রথম অনুভব করলাম, যেদিন এই তুচ্ছ ব্যাপারটি নিয়ে ফের দারুণ গণ্ডগোল শুরু হলো। এ নিয়ে ঝগড়া হয়ে উঠলো নিত্যদিনের বিষয়। এই প্রবাসে চাকরি ছেড়ে ঘরে থাকা! অসম্ভব! মা হওয়ার আগাম সমস্ত সুখই নষ্ট হয়ে গেল। বললাম, টাকার অভাব। যখন নেই, না হয় তোক রেখে নেবো। তুমি বেশ রূঢ় কণ্ঠে বললে, না। বললে, আমার সন্তান মানুষ হবে তার মায়ের কোলে। আমি বললাম, আমিও তো আমার মায়ের সন্তান। মা আমাকে পড়িয়েছেন। তাছাড়া এত ভালো কাজ। বিদেশে কি কেউ বসে থাকে! বললাম, তা কি থাকা যায়? কথায়, কথায় তর্ক বাড়লো। রাগ যখন চরমে, বললাম, তুমিই না হয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাচ্চা মানুষ করো। কেন করবে না? চাকরিটা আমি কেন ছাড়বো? তুমি এক চড় মেরে বললে, তোমার এই বাইরে থাকা আর ছেলেদের সঙ্গ আমার আর ভালো লাগছে না। আমি বুঝে গেলাম তোমার আসল তোমাকে! তুমিও সবার মতো সাধারণ। হঠাৎ ভীষণ উত্তেজনায় আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু জানি না।
সেদিন চোখ খুলে দেখলাম আমি হাসপাতালে। বিছানায় রাখা চার্টে লেখা–উচ্চ রক্তচাপ। স্যালাইনের সুই ডান হাতের কবজির ওপরে। বাম হাতে রক্তের ব্যাগ। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে! ডাক্তার বললো, আপনি এখন ঘুমোন। ডাক্তার, সেও লুকিয়ে গেল। বুঝলাম, আমার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গ্যাছে। প্রথম যখন জানলাম আমার অনুমানই সত্যি–তখন তুমি কাছে ছিলে না। না থাকাটাই ভালো ছিল। থাকলে না জানি কি ঘটতো। হয়তো দুই হাতের সুই ছিঁড়ে ফেলে হাসপাতালেই এক ভীষণ কেলেঙ্কারি বাধাতাম। তার তিনদিন পর প্রচণ্ড রক্তপাতশেষে জ্বণের অবশিষ্টাংশ পরিষ্কার করে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এলাম। তৈরি হলো এক অদৃশ্য দেয়ালের ভিত তোমার আর আমার মধ্যখানে। সৃষ্টি হলো দূরত্বের আকাশ, দু’জনের–আচরণে। আমি অনেক পুরুষের মধ্যে নারী বিষয়ে–হীনমন্যতা দেখেছি। কিন্তু তোমার মধ্যে সেই একই হীনমন্যতা, সেই সন্দেহ, যা আমি বরাবরই ঘৃণার চোখে দেখে এসেছি, দেখে নড়ে উঠলাম।