আজ এই দুর্গা পুজোর নবমীর রাতে, এই ঢাকের বাজনার ভিড় ছাপিয়ে যে মেয়েটির ক্ষীণ কণ্ঠ আমার কানে আজও বাজে, যে মেয়েটির অযত্নের বিশাল জটপাকানো চুল আমার চোখে বাধে, যে–যে মেয়েটির হাতে নোংরা দুর্গন্ধ–কাপড়ের পুটলি থেকে উদ্ভট গন্ধ–আমার নাক পুড়িয়ে দেয়! পেটিকোটে যার বারো মাসের ঋতুর রঙ লাগানো। লাল ছোপ ছোপ। পথে পথে পড়ে থাকে, ঘুমোয়, আকাশের নিচে। নোংরা, গন্ধ, অসুস্থ, উকুন, পেচ্ছাব সব-সব মিলে যে, নরক! ঠিক ধরেছেন এই সংসারত্যাগী, এই প্রথা ভাঙুনী, কবিতা। সে এখন পূর্ণ পাগল।
হ্যাঁ ও পাগল হয়ে গ্যাছে। পা-গ-ল! পা-গ-ল! লোকেরা সিটি দেয়। পেছন পেছন ‘রূপ তেরা মাস্তানা’ গান গায়। খোলা আকাশের তলে ইচ্ছে হলেই ওকে চুদে দেয়। প্রতিবাদ করে করে, প্রতিবাদ করা সে ছেড়ে দিয়েছে। পেট ফুলেছিল দু’বার। বারবার ধর্ষণে রক্তপাত হয়ে জণগুলো ধুয়ে গেছে। শহরের মানুষ ওকে চেনে। ব্যথায় কষ্ট পেলে–কেউ এসে ওকে ট্যাবলেট, কেউ খাবার দেয়। শহরের লোকেরা এই জমিদার বংশের কন্যার জন্যে দুঃখ করে। ওকে দয়া করতে চায়। নতুন শাড়ি। টাকা। সে হাতজোড় করে বলে, না-না-না। অতীত ভুলে গেছে সে। দুটো নাম তার মনে পড়ে। শশী আর বিধান। মাঝে মাঝে দূরে তাকিয়েই থাকে। থাকে তো থাকেই। অথচ দেখার কিছুই নেই। তবুও সে দেখে। ওদের কথা বলতে বলতে কবি খালি হাসে। হেসে ভেঙে পড়ে। ওর মধুর স্মৃতি কথা। একমাত্র সম্পত্তি।
কবি মাঝেমাঝেই এই শহরের দুটি বাড়িতে যেতে ভুল করে না। ঘর-সংসারী বিধানের বাড়িতে গেলে বিধান ওকে চেনে না। কবি তবুও বিধানকে হেসে হেসে কি যেন বলে, সেই জানে। কিন্তু শশীটা আজকাল মায়া করতে থাকে। কবি গিয়ে একটু দাঁড়ায়। কিছু বলে না। কিছু চায়ও না। দুয়ারে শীতল দাঁড়িয়ে মিনিট পাঁচেক পর চলে যায়। এটা ওর একটা নিয়মের মতো।
শশীর এই শহরেই বড় চাকরি হয়েছে। ভালো টাকা বিয়ে-থা সংসার হয়েছে। তবুও ইদানীং বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা কবিকে কেন্দ্র করে নষ্ট হয়েছে ওর। ওর বিবেকে কোথাও গণ্ডগোল বেঁধেছে। একটি মেয়ে, ওর নারী, একদিন যাকে ভালোবেসেছিল। যার শরীর নিয়েছিল। ইদানীং শশীর অপরাধবোধ, সমাজবোধকে ছাড়িয়ে গেছে। সে বিবেকের সগ্রামে ভোগে। ইদানীং সে অস্থির, অশান্ত। কবিকে। বললো, শোন! ওভাবে আর রাস্তায় রাস্তায় নয়। এসো তোমার জন্য একটা ঘর ভাড়া করে তোমাকে চিকিৎসা করাই।
কবি দুই হাত জোড় করে তার নিজস্ব ভাষা ও উচ্চারণে বললো–এই কথা কইয়েন না। …হা সত্যি, দয়া করে এই কথা বলবেন না। আপনাকে আমি চিনি। আপনিও এক প্রতারক। আমি বৈধ নই তাতে কী? কেন সেদিন প্রতিবাদ করলেন না? কি জন্যে? আর আজ কেন? জানেন না, আমার আমার, শশী আছে! তাকে নিয়ে আমি সুখে আছি। জানেন না! রাস্তা ভালো। সেখানে আমি স্বাধীন। আমি ঘর চাই না। কিছু লাগবে না। কিছু চাই না। না-না-না। বলতে বলতে, কবি হেসে গড়িয়ে পড়ে। শশী চুপ করে শোনে। মনে করার চেষ্টা করে, অতীত। আমার শশী! পুরোনো, পরিচিত। চির নতুন। গায়ে শিহরণ হয়। ফের মিলিয়েও যায়। স্নেহভরে, ভাত খাও কবিতা! ভাত! শশী, পরমস্নেহে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। এবার করুণ চোখ তুলে কবি বললো, দিবা! দেও। শশী নিজ হাতে ওর জন্যে একথালা ভাত-মাছ এক গ্লাস জল নিয়ে এলো। এইখানে বসো কবি–এইখানে। ভাত খাও, বললো। পেছন পেছন ওর স্ত্রী আর দুই মেয়েও এসে দাঁড়ালো। কবি খেয়ে চলে গেল। শশীর চোখে জল। বললো, কাল এসো। খেয়ে যেও–কবি!
১১. আজকের দিনের এক স্ত্রীর পত্র
তোমাকে,
গল্পগুচ্ছের–”স্ত্রীর পত্র” বারবার পড়েও যেন পড়া শেষ হয় না। তার কারণ হয়তো এর বিষয়ের গভীরত্ব বা জীবনবোধ, যা মানুষের মনকে অন্তহীন চিন্তার সাগরে ডুবিয়ে দেয়। মানুষকে করে তোলে ভাবুক। ঘর ছেড়ে এসে মৃণালের মতো মনে হলো তোমাকেও এরকম একটা চিঠি লেখা জরুরি হয়ে পড়েছে। আজ সেই সময়। আজ সেই গোধূলিলগ্ন। তবে কেমন করে তা লিখবো সে নিয়ে বিড়ম্বনা। লেখার বিষয় এত বেশি, আর সমস্যাগুলো এত অন্যরকম যে সেজন্যেই হয়তো আমার মধ্যে এই। জটিলতা দেখা দিয়েছে। যেমন কি বলবো, কি লিখবো, কেমন করেই-বা ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মৃণালকে দিয়ে যা বলাতে চেয়েছিলেন, সে কাজটা শুরুতেই। তিনি স্পষ্টভাবে করিয়ে নিয়েছেন।”আমি তোমাদের মেজো বৌ। আজ পনেরো বছর পরে এই সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে জানতে পেরেছি, আমার জগৎ এবং জগদীশ্বরের সঙ্গে অন্য সম্পর্কও আছে। তাই আজ সাহস করে এই চিঠিখানি লিখছি। এটা তোমাদের মেজো বৌয়ের চিঠি নয়। কোথায়রে রাজমিস্ত্রির গড়া দেয়াল! আইন দিয়ে গড়া কাটার বেড়া। ঐ তো মৃত্যুর হাতে উড়ছে জীবনের জয় পতাকা। …আমি আর তোমাদের সাতাশ নম্বর মাখন বড়ালের গলিতে ফিরব না।”
আমিও সংসারের সকল বন্ধন উপড়ে ফেলে, অর্থের সকল প্রাচুর্য, মোহ, ত্যাগ করে ফিরে এসেছি সুদূর থেকে এই ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। আমার শৈশবের স্মৃতিঘেরা-নদী। আমারও মাথার ওপরে আষাঢ়ের জলভরা আকাশ। দূরে, মাছ ধরা। নৌকো থেকে কিছু আলো জোনাকির মতো ভেসে আসছে ব্রহ্মপুত্রের জলে। এখন। অনেক রাত। লোকেরা এত রাতে একটা মেয়েকে এভাবে একা একা বসে থাকতে দেখলে ভাববে আস্ত পাগল। ভাবুক। পাগল ভালো। কারণ তারাই একমাত্র অতীত ভুলে যেতে পারে। অতীত, যা আমি ভুলতে পারবো না। কারণটা বড় জটিল, ভীষণ নরক।