ছ’মাস পর। শুধু প্রেমে হাবুডুবুতে কি পেট ভরে? ভরে না। সঙ্গে যা ছিল, ফুরিয়ে আসছে। ভালো কোনও কাজ হলো না। কথায় আছে, সুখ ছাড়া প্রেম জানালা খুলে পালিয়ে যায়। ঘরে প্রায় কিছুই নেই। তবুও সংসার। মাটিতে পড়ে থাকা তোশক। দু’চারটে বাসন। দুজনেই জানে, আনুষ্ঠানিক বিয়ের অর্থ ওদের নেই। প্রয়োজন ভালো কাজ। কাজ হলো। বাসা হলো। আর আনুষ্ঠানিকতার রাতেই, দুর্বলচিত্তের শশী, যার নামের সাথে আসে চাঁদের কলঙ্ক, হঠাৎ উধাও। নেই তো নেই। কোথাও নেই। কবি পুরো এক সপ্তাহ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াল ওর শশীকে। কেঁদে-কেটে অনাহারে অসুস্থ হলো। তবুও ফিরে যাবে না। যদি শশী ফিরে আসে। মা বলছে, ও বাবা-মায়ের কাছে চলে গ্যাছে। কবি বিশ্বাস করে না। সে যাবে না। কখনো না। বাবা-মা ঘরে তালা দিয়ে ওকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যায়। আর সেই সঙ্গে সাঙ্গ হলো ওদের ছ’মাসের স্বামী-স্ত্রী খেলার সংসার। যেখানে প্রেম থাকলেও সই ছিল না। এবং যুতসইভাবে ফিরে যাওয়ার পর বিয়ে হয়েছে কি হয়নি তা নিয়ে দুই পক্ষের তুলকালাম, প্রায় লাঠালাঠি। সই হলে এক, না হলে অন্য। শশীকে ওর বাবা-মা প্রহরায় আলাদা করে রাখলো।
শশীর কাছে কবি ছুটে চলে যায়। –আমি যাবো। যেতে দাও। ওকে ধরে রাখা যায় না। লোকেরা ভিড় করে তামাশা দেখে। মন্তব্য করে। কবিকে ওরা বাড়ির সীমানায় আসা বন্ধ করে দিলো। তবুও কৌশলে শশীকে সে দেখে, যাচ্ছে, আসছে। কিন্তু শশী ওকে দেখলে চোখ ঘুরিয়ে ফেলে। যেন-চেনেই না। একি কোনও কষ্টের মুখোশ! এড়িয়ে যাওয়ার! শশীকে ও নাম ধরে ডাকে। কেঁদে কেঁদে ডাকে। শশী একবার কথা বলো। একবার! ধর্ম মনুষ্যত্ব বলে কি তোমাদের কিছুই নেই? শশীর ভেতরে তুফান। ভুলে যেতে হলে, না চেনাই ভালো। না চেনার ভান করে কবিকে ভুলে থাকে। কঠিন সমাজ। সামাজিক কেলেঙ্কারি। এই ঘটনার শেষে ওকে ভুলতে হবেই। হঠাৎ একদিন শশীকে আর দেখা গেল না। সেই থেকে ওর কোনও সংবাদও কেউ আর জানলো না।
তারপর থেকে কবি, পুরো একবছর অসুস্থ। ভোলা কি যায়? যাওয়া কি এতই সহজ? প্রেম, যাকেই ভালোবেসে গড়ে ওঠে সে ভুল হোক আর ঠিক, তার কাছে সেই প্রেম সত্য। সে যত দরিদ্র বা যত কুৎসিত হোক, প্রেমের একটা তৃতীয় চোখ থাকে। সে চোখ অন্ধ। সেই চোখ শুধু তার সৌন্দর্য ছাড়া নোংরা দেখতে পারে না।
অভ্যস্ত প্রেমের শূন্যতা কি অত সহজে মেটে! কবি ওর নিজস্বতা হারিয়ে এবার ভিন্ন এক কবিতে রূপান্তর হয়। এই কবির সঙ্গে আগের কবির কোনও মিল নেই। শূন্যতা পূর্ণ করতে সে নতুন ভ্রান্তিপাশের খোঁজে বের হয়। অস্থির দুর্বলচিত্ত শুধু তাকেই খোঁজে আর খুঁজে খুঁজে হয় আরো ও ভ্রান্তিপাশের শিকার। স্বাভাবিক বুদ্ধি-জ্ঞান তখন লোপ পায়। কবিকে নিতে হলো পাগলের ডাক্তারের কাছে। একবছর, দু’বছর…। কবি সুস্থতার দিকে। তিন বছর পার হয়ে গেল শশীর চলে যাওয়ার। কবি একটু সেরে উঠেছে অতীতের ক্ষত থেকে। এবার বিধান। সে মুগ্ধ হয়। বিধানে সে, শশী দেখে। যেন যমজ দেখে। শশীর কাল সাপটিকে হত্যা করতে কবি দৌড়য় বিধানে।
দুটো ফুল একই বৃন্তের না হলেও যদি একই গাছে ফোটে বা পাশের গাছটি যদি এপাশের গাছের মতো হয় তবে, যমজ নয় কিন্তু ফুলগুলো গন্ধে, বর্ণে, রূপে, রসে এক। ফুটবে এক সাথে। ঝরবেও একই সাথে। পরমায়ু–উদ্দেশ্য–জীবন, সবই এক হবে। শশী আর বিধান এক বৃন্তে না হোক, একই পরামায়ুর। একই পরিতাপের! কবির সন্দেহ যায় না।
কিছু মানুষ জন্মায় সুখ করতে। আর কিছু মানুষ, দুঃখ। কিছু ভালো মানুষ যারা সহজ, সরল, যারা প্রথার তোয়াক্কা করে না, যারা জীবনটাকে দেখে শুধুই ফুরিয়ে যাওয়া পরমায়ু! পৃথিবীতে যাদের জীবনে প্রেম ছাড়া, স্নেহ ছাড়া চাইবার কিছু নেই, যারা পৃথিবীর এত জটিলতা, এই পঙ্কিল আবর্জনা, এত মিথ্যে, নিষ্ঠুরতা, অসুন্দরকে চোখ বুজে এড়িয়ে যায়, যারা বোঝে না কোনও হিংসে, কোনও জাত-বিভেদ! কিছু মানুষ আছে। সত্যিই কিছু মানুষ আছে যারা, উত্তমকে তাদের জীবন দর্শনে অবলম্বন। করে, শুধু কষ্টই পায়। আর কষ্ট করতেই শুধু, জন্ম তাদের।
তারা নির্বোধ নয়, তবে সরল। ফলে মানুষের প্রতারণার বিষ খেয়ে, ওরা নীলকণ্ঠ শিবের মতো নীল হয়ে যায়। নিষ্পাপ, কখনো কখনো অতিরিক্ত সারল্যের সঙ্গে মিশে সৃষ্টি করে দুঃখ। আর কবির মতো সহজ-সরল মেয়েরা, সেই দুঃখই পায়।
কবিতা সেই নীলকণ্ঠ শিবের বিষ। গেছে শশী। এবার গেল বিধান। কি অন্যায়! ভাবে কবি। সেদিন কবি গিয়েছিল–আশুলিয়ায় একটা কাজে। সেখানেই বিধানকে দেখতে পায় অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে। ফ্যান্টাসি আইল্যান্ডে ওরা এক প্লেট থেকে তুলে দু’জন ফুচকা খাচ্ছে। খাইয়েও দিচ্ছে। হাসছে। হাসতে হাসতে প্লেটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছে। চুলের বিনুনি পড়ছে প্লেটে। কৃত্রিম খেজুর গাছের শরীরে। তারপর আইসক্রিম। আইসক্রিমের পর ফের ফুচকা। তারপর চটপটি। নতুন প্রেমের সব ছেলেমানুষির চিহ্ন। কবি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো।
কত সুখ ওদের! দূর থেকে দাঁড়িয়ে কবি হাঁফ ছাড়ে। ক্লান্ত দেহ মন। আর পারে না। বিসর্জন দিতে চায়। তাও পারে না। ভ্রান্তিবিলাস ওকে সুস্থমতো ভাবতে দেয় না। হৃদয়, বাস্তবকে ছাড়িয়ে যায়। তৃতীয় চোখে বলে–এটা স্বপ্ন। এই দেখা, ভুল। ওর মতোই কেউ! কিন্তু সে নয়। হায়! কি কঠিন কি দুরন্ত কঠিন এই, বাস্তব! ইচ্ছে হয় মনটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে। অনুভূতিগুলোর শেকড়টা উপড়ে নির্বংশ করতে! তবেই হয়তো কাউকে আর ভালোবাসতে ইচ্ছে হতো না। এই যে বিধান গতকাল ওর নাইকুণ্ডলীর নিচে নেমেছিল বলে ওর সকল সঞ্চিত স্মৃতি, আর আজ এই যে অন্য একটি মেয়ের নাইকুণ্ডলীর ওপরে ওর হাত, তলিয়ে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি, রাতে যে প্রস্তুতি প্রাণ পাবে সজ্জিত সম্ভারে! সইতে না পেরে হাতের কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেলে। খেজুর গাছে মাথা কোটে। আকুল কাঁদে যেমন কেঁদেছিল একদিন শশীকে হারিয়ে। এবার সে একটা রিকশায় চেপে বসলো। বিধান মেয়েটির সঙ্গে গাড়িতে। হাসতে হাসতে গাড়ি চালাচ্ছে মেয়েটি নিজে। পাশেই শীতলক্ষ্মা। রাজ্যের নোংরা-যতরকম আবর্জনা-নৌকোর অস্থিরতা-জেলের ভারি জাল-সব ছুঁড়ে ফেলা দায়ভারে যন্ত্রণা বুকে করে বয়ে চলে, অভিযোগহীন। কবি বাড়ির দিকে যায়। যেতে যেতে তাকায় জলের গভীরে।