সবশেষে দেখা হলো এমন একজনের সঙ্গে যে আমারই সমস্ত অনুভূতিতে আমাকে সাপটে-লেপটে গেল। মেয়েটি শহরের এক আলোচনার বিষয় বটে। এক বিচিত্র সে। হেঁটে এসে বসলো। কিছুটা আগন্তুকের মতো। আবার চিনি চিনিও ভাব। তার চোখেমুখে ক্লান্তি। ওর দিকে তাকিয়ে সন্দেহ সেই মেয়েটি! না, না। দ্বিতীয় মন বললো, কেন হবে না! পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কি কিছু আছে? কি হাল! অশান্ত অস্থির জীবন খুঁড়ে কোনদিনও কি সে আর, জাগবে? মরা নদী কি জাগে? হা, হ্যাঁ, জাগে। জাগবে না কেন? আয়ুর প্রত্যাশা কার নেই? মৃত্যুর আগেও বলে যাবো না। যাবো না। কিন্তু কবিতা! ওকে দেখে মনে হলো ওর সেই প্রত্যাশা নেই।
বিভ্রান্ত-বিচ্যুত–বিদিশা!
মানুষ যখন ভ্রান্তিপাশের শিকার হয়, তখন সে এক ভ্রান্তিপাশ ছেড়ে অন্য ভ্রান্তিপাশে, দৌড়য়। ভ্রান্তিপাশ তাকে ছেড়ে যায় না। তার কাছে মনে হবে এই ভুলই, সত্য। ভুল আর নির্ভুল এই দুটোকেই গুলিয়ে ফেলে ক্রমশই ঘোলা জলে মাছ শিকারের মতো, হাতড়াতে হাতড়াতে একদিন হতাশার প্লাবনে নিঃশেষ হয়ে যায়। অবশেষে সে অস্ত। যায় তার জীবন আকাশ থেকে। মেয়েটির দু’চোখে চাঁদ ছেঁড়া সেই প্লাবন নেই! ছোটবেলায় ওর দু’চোখে প্রতিভার যে আগুন আমি দেখেছি, সে আগুনে আজ জলে থিতোনো ছাই। সে ধসে গ্যাছে।
আমরা একই ক্লাসে একই স্কুলে পড়েছি। স্কুল কেটেছি এক সাথে। আচার কিনে ভাগ করে খেয়েছি। ছোট থেকেই সে ভালো ছাত্রী। গানে ভালো। নাচেও। ওর নাম কবিতা। ওরা আমাদের পাশেই থাকতো। কবিতা আমার মতো। কারো কথাই শুনতো না।
আর একদিন করেও বসলো–যা খুশি। অবিশ্বাস্য কিন্তু ওর জন্যে অসম্ভব নয়। বিলেত যাওয়ার কথা বলে একদিন সে উধাও হয়ে গেল একটি শশীর সঙ্গে। শশী, কবির উপযুক্ত কিছুতেই নয়। সবার মনোযোগ কেড়ে নেয়া এই মেয়েটি–শশীর খপ্পরে কি করে যে পড়লো, ওর বাবা-মায়ের সেটাই দুঃখ। শশী, সব দিক দিয়েই কবিতার নিচু। কিন্তু প্রেম তো প্রেম। প্রেম, অন্ধ। কবিতাই, শশীতে ডুবে গিয়েছিল।
প্রেমের জন্যে অসামান্য ত্যাগের উদাহরণের কি কিছু আকাল পড়েছে? একটি নারীর জন্যে সিংহাসন ত্যাগের মতো ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনী কি, অলৌকিক? প্রেম-সে কি শুধু মোহ? সত্য নয়! স্বর্গ নয়! আলো নয়! যদি নাই হবে তবে, কেন এই সিংহাসন ত্যাগ? আত্মহত্যার মতো ক্ষমাহীনতা! এই দুঃখকষ্টভার! কে ছোট! সিংহাসন। না প্রেম? ধর্মদ্রষ্টাদের রুচিমাফিক, প্রেম। তাহলে তাকে কি বলবো যখন ব্যর্থ প্রেম, মানুষের জীবনকে রক্তাক্ত করে। যখন সে হেলাফেলায় ত্যাগ করতে পারে রাজ সিংহাসনের মতো দুর্লভ সম্মান, সম্ভ্রম। তুচ্ছ করে জীবনের মায়া। আর সেকথাই প্রমাণ করলো কবিতা।
শশী ভালো ছেলে তবুও কবিতার যোগ্য সে নয়। কিন্তু কবিতার চোখে শশী, শশীই। রক্তে হলুদ লাগা পূর্ণিমার চাঁদ সে! শশী ভালো-মানুষ। আর এই ভালো মানুষকে কবিতার বড়ই ভালো লাগতো। পুতুল-পুতুল। সুন্দর। সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখতো কাব্য করে। ওকে দেখলেই কবিতার চুমু খেতে ইচ্ছে করে। শুতে ইচ্ছে হয়। কবি, যৌবনে উত্তাল এক অনন্য কিশোরী।
এক কালের জমিদার বাড়ির মেয়ে কবিতা। জমিদারি নেই। তবে রক্তে আছে ঐতিহাসিক পাপের অতীত। বংশের একটা দুর্নাম আছে। লোকেরা আজো বলে, কবিতার জেঠতুতো কাকার ঠাকুরদা জমিদার ইন্দ্রমোহন সেন, প্রজাদের কর অনাদায়ে নিতেন, তাদের জমি আর সঙ্গে সুন্দরী মেয়ে। অমন অত্যাচারী জমিদার সে সময়ে নাকি আর দ্বিতীয় বলতে কেউ ছিল না। কবিতা তাদেরই বংশ। কিন্তু একবারেই উল্টো সে। শীতের শিশিরকণার মতো সরল। আবার বর্ষার মতো অস্থির। তবে বিদ্যা-বুদ্ধিতে অসামান্যা হলেও, সে হৃদয়ে শিশু। যে শিশুটি তার গোলাপি ভবিষ্যৎ ভালোবাসার কাছে সব তুচ্ছ করে উধাও হয়ে যাওয়ার আগে এক মুহূর্তও ভাবলো না, … তারপর?
শিগগির বিলেত যাচ্ছি। বিলেত! কেন-কোথায়-কার কাছে-কবে-কি করে! যা জিজ্ঞেস করতেই বললো, একটা ভিসা জুগিয়েছি। প্রথমে নার্গিসের ওখানেই থাকবো। পড়বো। চাকরি করবো। দেশে ভবিষ্যৎ নেই। নার্গিস ওর বান্ধবী। মা সেকথা ভালো জানেন। শুরু হলো ওর বিলেত যাওয়ার প্রস্তুতি। জিজ্ঞেস করলেই মাকে একটা কিছু বুঝিয়ে দেয়। চালাক হওয়ার সুবিধেই তাই। চটজলদি বুঝিয়ে থিতিয়ে দেয়া যায়। কবিও বোঝাত। কবিকে বিশ্বাস করা না করার কারণ নেই, কারণ কবির জন্যে আশ্চর্য কিছু নেই। তবে ওকে বাধাও দেয়া যাবে না। দিলে শুনবে না। ইংল্যান্ড যাওয়াটাকে সে এভাবেই বাড়িতে ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত করে নিলো। মা ভাবলো, যাক এই সুযোগে সে শশীকে ভুলে যাবে।
সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা। বিপদ বুঝে দু’জনে মিলে ঠিক করলো পালিয়ে প্রথমে রাজশাহী যাবে। গিয়ে প্রথমে সেলিমের ওখানে উঠবে। তারপর রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করবে। আর এই পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির নামই বিলেত যাওয়া।
নেই-নেই, লন্ডনের কথা বলে ছ’মাস ওরা নিখোঁজ। শশী আর কবি রাজশাহীতে আছে, কিন্তু বিয়েটা হয়ে ওঠে না। দু’পক্ষেরই বাবা-মা সেকথা জানেন। পরস্পরকে দোষারোপ করেন। শহর জাগিয়ে ঝগড়া করেন। অভিশাপ দেন। ও বলে তুমি, সে বলে তুই। আমার ছেলেকে, আমার মেয়েকে, ভাগিয়ে নিয়েছ, নিয়েছিস, তুই, তোরা, তোর ছেলে, তোর মেয়ে, এ্যাই! এ্যাই। ওরা কেউ যাবে না, কিছুতেই ওই নচ্ছার ছেলেকে-মেয়েকে দেখতে যাবে না। ছ’মাস বাড়িতে শোক। প্রচার হয়ে গেছে–ওদের বিয়ে হয়নি। এমনিই থাকছে। দুর্নামের পর দুর্নাম। বিয়ে হয়েছে কি হয়নি, এ নিয়ে শশী আর কবিরও সন্দেহ। তবে সই দিয়ে কিছু ঘটেনি। তাকে কী? ওরা সংসার করে। যায়। আইন ও সমাজের চোখে স্বামী-স্ত্রী হতে হলে সই লাগবে। সামনে বিপদ।