এই বয়সেও কত সখ আমার? সমুদ্রের পাড়ে, স্বামীর বুকে শুয়ে সূর্যের আলো খেতে ইচ্ছে হয়। পূর্ণিমা রাতে এক নিঃসঙ্গ গাছের তলায় শুয়ে ওর গায়ের গন্ধ নিতে আমার ইচ্ছে হয়। ভোর ছুঁই ছুঁই রাতে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো চাইতে ইচ্ছে হয় দাও প্রেম, দাও অমৃত সুধা। মধু দাও। দাও গো-ও-ও-ও। এবং আমি জানি মানুষের সুখের চাওয়াগুলো সব, এক। পাথরের তলে, লোহার নিচে, শক্ত মানুষটিও কত দুর্বল তার হৃদয়ের কাছে আমি জানি।
রিনি বয়সে আমার চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের ছোট। ওর ইচ্ছেগুলোর বয়সও পাঁচ বছর–তরুণ। তারুণ্যের চাওয়া অধিক প্রখর। কে বলেছে, না! আমাদের সমাজ আজও বলে–বিধবার আবার ইচ্ছে কি? খুলে ফেল হাতের, কানের, গলার! ঝেড়ে ফেল গা থেকে কামের গন্ধ। মেরে ফেল-রতি। হেঁটে দাও মাথার বিনুনি। রঙিন, ফেলে দাও।
রিনিকে সুধালাম ওর ভালোমন্দ। ওকে ঘিরে শোনা নানান নোংরা। রিনি বলেন, যখন না খেয়ে থাকতাম তখন কেউ ঘরে উঁকি দিয়েও দেখেনি। আর আজ, ওরা উঁকি দেয় কে এলো দেখতে। বললো, তাতে আমার কিছু এসে যায় না! দারিদ্র আমি ঘৃণা করি। গরিব থেকে থেকে আমার চামড়া পচে গ্যাছে। জানেন! মৃত্যুর আগে সে এমন সব মাছ দিয়ে ভাত খেতে চাইলো, বললো–আমি কই মাছ, রুই মাছ দিয়ে ভাত খেতে চাই। আর আমি দশ টাকা কর্জ করে কিনে আনলাম পুঁটি। সেসব মাছ কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না। আজ আছে, কিন্তু রঞ্জন নেই। দারিদ্র ঘৃণা করি। …চামড়া পচে গ্যাছে…। কি সাঙ্ঘাতিক কথা তিনি বলতে শিখেছেন! একি তারই কথা! গ্রামের একটি মূর্খ অকাল বিধবার! নাকি দর্শন, যা জীবন ঘেঁটে নেয়া! দর্শনের এই বয়ান, জীবন ঘটতে যারা নর্দমায় যায় শুধু তারাই পাবে। এবং তারাই প্রকৃত মানুষ। রিনি সেই অর্থে প্রকৃত মানুষ। মনে মনে ভাবি।
মতিনের সাথে তোর কি সম্পর্ক! অনেকেই বলছে, মতিন তোকে পৌরসভার ইলেকশনে দাঁড় করাচ্ছে। আর সেজন্য অনেক অর্থও সে ঢালছে তোর পেছনে! পোস্টার, মাইক, আলোচনা! ব্যাপারটা কী।
-রিনি, বললেন হ্যাঁ দাঁড়াচ্ছি। মতি ভাই চায় আমি ইলেকশান করি। চায়, আমি…। বলেই তিনি থামলেন।
আমি মতিনকে চিনি। সে আমাদের প্রতিবেশী। ওদের দুজনের বিষয়ে কৌতূহল ছিল বলেই রিনিকে আমি খুঁজছিলাম। আর সমাজ এজন্যেই, অসুখী। সুখ! মানুষ কি সুখ বোঝে? সুখ মানেই নয়, স্বর্গীয় পবিত্রতা–ব্রাহ্মণ, যা নিষ্পাপ। সুখ, সে নরক থেকেও আসতে পারে। পারে, সঞ্চিত আবর্জনা ঘেঁটে কিছুর সন্ধান করতে। আর এই পেট উগরে আসা আবর্জনার মধ্যে পাওয়া অতীতের কারো এক টুকরো চিরকুট, কিংবা একটুখানি জীবনের সন্ধান পাওয়ার সুখ। কারো কাছে সেটাই স্বর্গ। সেই –জীবন।
বললাম, মতিন তো বিবাহিত। তার ওপর সে মুসলিম। এ তো আগুন নিয়ে খেলা। তোর ভবিষ্যৎ কী? কিছুক্ষণ চুপ থেকে কোন দ্বিধা ছাড়াই বললো, মতিন ভাই বলেছে, দু’মাস পর আমাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নেবে। তাছাড়া মতিন ভাইয়ের বৌ সারা বছরই অসুস্থ, প্রায় পঙ্গু। সেও জানে। তুই মুসলিম হবি! জিজ্ঞেস করলাম। কেন হবো না। মানুষ মানুষই। ধর্মবোধ যারযার ব্যক্তিগত। সে আমায় বাকি জীবন খেতে দেবে-পরতে দেবে। মতিন ভাই নির্ঘাত দেবতার মতো মানুষ। অন্য কেউ নয় স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র সেই আমাকে চরম দুঃসময়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। সে নির্ঘাত দেবতা।
এবং এরপর রিনি চলে গেলে আমি ভাবছি রিনি যা পারে, আমি কী পারতাম?
২. দ্বিতীয়া
এরপর এলো একসঙ্গে এক জোড়া সতীনের, একজন। আমার বান্ধবী লিপি। মধ্য বয়সের, ক্ষয়ে যাওয়া চেহারার এক নারী। বাচ্চা হয় না বলে বহু ধর্মকর্ম অনেক টাকা দান-দক্ষিণা, পীর, সন্ন্যাসীশেষে সন্তানের আশা ব্যর্থ হলে শেষে, এক ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তিনি পরীক্ষা করে বললেন, তোমার যে জরায়ুই নেই! বাচ্চা কি করে হয়? লিপির প্রশ্ন তাহলে এই মন্দির, এই অর্থদান! সব বৃথা। ডাক্তার বললো, ওগুলো ভণ্ডামো। আপনাদের দোষ যে আপনারা ওখানে যান। এবং এই সত্য প্রকাশের এক মাসের মধ্যে স্বামী আবার বিয়ে করলো।
লিপি বললো, নন্দন ওকে ভুলে গ্যাছে। নন্দনের দুই ছেলের মা, সতীনের পাশে সে একটা-না থাকা, ছায়ার মতো। একজন অতিরিক্ত মানুষ যাকে না হলেও চলে। নিজের স্বামীকে এভাবে বছরের পর বছর অন্য নারীর বিছানায় দিয়ে ভেতরটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে গেছে। বললো এখন সে মৃত্যু চায়। নিজের স্বামীকে অন্যের বুকে বিসর্জন দিয়ে নরকের সঙ্গে তার এক যুগের সংসার সে ঘোচাবে। সে আত্মহত্যা করবে। লিপির দুই মৃত চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন আমার আর ইচ্ছে হলো না বলতে, না মরিস না। বরং বললাম, কর, তোর যা খুশি। তাতেও যদি তোর শান্তি আসে। জীবন আকাশে যখন সূর্যাস্ত, সে জীবন জীবনই নয়। বরং সে জীবন থেকে মুক্তি নেয়া ঢের ভালো। তবুও মনে আমার এক সূক্ষ্ম বিশ্বাস ছিল যে লিপি একদিন না একদিন আলোর সন্ধান পাবে। সে বেরিয়ে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত বেরিয়েও এসেছে। শুনেছি, নন্দনকে ডিভোর্স দিয়ে সে সবার বিরুদ্ধে একা, সবার ছিছিক্কার দলিয়ে দিয়ে এক বিপত্নীক তিন সন্তানের পিতাকে বিয়ে করে বিশাল ঘর-গেরস্তি নিয়ে বেশ সুখে শান্তিতেই আছে।
৩. তৃতীয়া—