বসন্তের হাওয়া, তার ছোঁয়া হৃদয়ে নতুন করে আবার লাগতেই পারে। বিবাহিত স্বামী নয়, স্ত্রী নয়। একেবারেই অন্য কাউকে ভালোবেসে। দেখা দেয় শুকিয়ে যাওয়া ফুল গাছটায় নতুন করে কুঁড়ির সম্ভাবনা। তাকে দেখলেই বোঝা যায় যে সে প্রেমে পড়েছে। সমস্যাটা প্রেম নয়, বরং তার বৈধতা। দু’দশক আগে যাকে ভালো লেগেছিল তাকে আর ভালো লাগে না। দু’দশক আগের সেই মন এবং শারীরিক ক্ষুধা তাকে দেখলে আর জাগে না। তবে তা জাগে, তা আসে, অন্য কাউকে দেখলে। তার গন্ধ পেলে। তার নাম শুনলে। তার কণ্ঠের শব্দে স্পন্দিত হয় সমগ্র নার্ভাস সিস্টেম। যেখানে পৃথিবীর সবরকম যুক্তিই তুচ্ছ।
তুচ্ছ, আসলেই কী? পরকীয়া প্রেম বলে কোনও শব্দের প্রয়োজন কি থাকা উচিত? ধর্ম-জাত-বর্ণ-লিঙ্গ-বয়স, প্রেম কি এসব কারণে বৈধ কিংবা অবৈধ হওয়া উচিত?
সমকামীরাও প্রেমিক-প্রেমিকা। তারাও ভালোবাসে। কালো এবং ফর্সা ওরাও ভালোবাসতে পারে। ছোট্ট ছোট্ট বালক-বালিকারাও প্রেম করে। প্রেম করে বয়স্করাও। এমনকি থুথুরে নারী ও পুরুষও। তবে একেক বয়সের প্রেম একেক রকম। ধর্মের বিষয়টা আমার জীবনেও ঘটেছিল। আমরা একজন হিন্দু আর একজন মুসলিম। সমাজ আমাদের প্রেমের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু আমাদের প্রেমের তীব্রতা, অভিভাবকের হস্তক্ষেপ এবং সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছিল বেশ নিষ্ঠুরতার সঙ্গে।
আমাদের বেলায় নিষ্ঠুরতা করাটা সহজ হয়েছিল কারণ বিয়ের পরপরই আমরা। আমেরিকায় পালিয়ে আসি ইমিগ্রেশন নিয়ে। ফলে সোশ্যাল হিউমিলিয়েশনটা ধীরে ধীরে হালকা হয়ে যায়। ভারত কিংবা বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের বিয়েটা এখনও গ্রহণযোগ্য নয়। অধিকাংশ সময়েই তা সামাজিক পাপ। অভিভাবকদের হস্তক্ষেপে সেই প্রেম ভেঙেও যায়। হৃদয়ের ওপর জোর খাঁটিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের অন্যত্র বিয়ে। দিয়ে দেয়া হয়।
সোশ্যাল হিউমিলিয়েশন আমাদের পরিবারে একেবারেই যে ঘটেনি তা নয়। আমার বিয়ের কারণে পরবর্তীকালে আমার পরিবারের অনেকের বিয়েই ভেঙে গেছে এবং আমার পরিবারের অনেককেই দীর্ঘদিন মৌখিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। সেই লজ্জায় অনেক অশ্রুপাতও ঘটেছে। তবে সেসব এখন অতীত। কোয়ার্টার সেঞ্চুরি পেরিয়ে আজ আমরা দু’জনে যেখানে আসতে পেরেছি এক সঙ্গে, দু’জনের একসঙ্গে হেঁটে আসা এই যে একটা সাফল্যের মাইলস্টোন, আমাদের বিয়ে যদি না হতো ধর্মের কারণে তা হলে এর পেছনে সমাজ কী যুক্তি দেখাত? যদি পারতো তা হলে সেটা কীরকম হতো? আর না পারলে? তার মানে এই নয় যে, এখান থেকেও কোনও পরিবর্তন বা বিচ্যুতি ঘটবে না। এমন কোনও নিয়ম কোথায়ও লেখা নেই। প্রেম কখন যে তার খোলস বদলাবে তা বলাটা দুরূহ।
পরকীয়া বা অবৈধ প্রেমের অনেক মুখরোচক ঘটনা, বিশেষ করে যখন তা ঘটে সেলিব্রেটিদের জীবনে, তা জানাজানি হয়ে গেলেই খবরে পরিণত হয়। রিপোর্টাররা ক্যামেরা নিয়ে জাহাজ ভাড়া করে তাদের ছবি তুলে ট্যাবলয়েডের কাটতি বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ পাশ্চাত্যে-প্রিন্সেস ডায়ানা, ম্যাডোনা, মাইকেল জ্যাকসন, লিজ টেলর প্রমুখের কথা বলা যায়। লেটেস্ট সোপ অপেরা চলছে বর্তমানে নিউইয়র্ক সিটির মেয়রের প্রেমকাহিনী ও বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে।
যারা সেলিব্রেটি নয় তাঁদের কাহিনী ট্যাবলয়েডের কাটতি বাড়ায় না, সেসব সাধারণ মানুষের অবৈধ প্রেমের সংবাদ অন্যরকম প্রাধান্য পায়। তাদের নিয়ে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়।
সকালের সূর্য ওঠার মানেই কি অস্তমিত চাঁদের প্রতি অবিচার! সূর্য আর চন্দ্র আছে বলেই না বৈচিত্র্য আছে। বৈচিত্র্য থাকা ভালো। তাতেও জীবনের জোয়ার থাকে। জোয়ারে আনন্দও থাকে ঢেউয়ের পরতে পরতে। প্রেমও ঠিক তেমনই। বৈচিত্র্য আসে তাতে।
স্থবির নদীতে বান ডাকলে কি তা দোষের? যাদের চোখে তা দোষের, তারা চায়। নদী মরে যাক তাও ভালো, তবুও এখানে বান না ডাকুক! এখানেই কাজ করে বৈবাহিক সম্পর্কের স্পর্ধা।
যুগে যুগে প্রেম এবং ভালোবাসা গড়ে উঠেছে নারী আর পুরুষের মধ্যে। বাধার সম্মুখীন তারা হয়েছে। বাধার সম্মুখীনে প্রেমের তীব্রতা বেশি। এবং এ তীব্রতার কারণে প্রাপ্ত শাস্তি বেত্রাঘাত থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড।
প্রেমের প্রকাশ কামের মাধ্যমে। কামসূত্রই তার প্রমাণ। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে কামসূত্রের বইয়ের ছবির মতো হাজার হাজার ছবি খোদাই করা আছে, যা সারা বিশ্বের পর্যটকেরা এসে দেখে অবাক হন। উদাহরণস্বরূপ কোনারকের সূর্য মন্দির। এসব সভ্যতার বয়স আড়াই হাজার বছর।
অবাক লাগে, সে-সময়েও মানুষের দৃষ্টি ছিল কত উদার। মন কত মুক্ত। সমাজ কত অরক্ষণশীল এবং কত খোলামেলা। মন্দিরের গায়ে উলঙ্গ-অর্ধউলঙ্গ বিভিন্ন চরিত্র, প্রেম ও কামের ছবি বিভিন্ন আসনে নারী ও পুরুষের, স্তন-যোনি এবং লিঙ্গের বিভিন্ন ভঙ্গিতে খোদাই করা ছবি মন্দিরের গায়ে শোভা পাচ্ছে। আধুনিক যুগের মানুষেরা সেগুলো দেখে কি অবাক হয় না? ভাবুন যে, সে যুগের মানুষেরা কত খোলাখুলি, কতটা মুক্তমনে প্রেম করেছে। তাদের আফসোস হয় না কি এসব দেখে, হায়! এত বছর ধরে বিবাহিত জীবনযাপন করলাম। কতবার প্রেম করলাম। কিন্তু একী! আজ অবধি পেটিকোটের ফিতে কিংবা ব্লাউজের বোতামটা খুলে কখনও দেখিনি আমার প্রিয়ার শরীরের সৌন্দর্য, সে কেমন?