এখন সকালের পাখিগুলো রোদের তৃষ্ণায় ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। ঘাপটি মেরে থাকা লাল সূর্যটা ক্রমশ রোদ হচ্ছে। আজ এই তরুণ রোদের আলোয় আমি আমার নিজের শরীর নিজে দেখতে পাচ্ছি। জেগে ওঠা পৃথিবীর–কলরবে নিজেকে আমি অনুভব করছি। মনে হচ্ছে, আছি। সত্যিই বেঁচে আছি, হ্যাঁ, আমি সত্যি সত্যি বেঁচে আছি, মনে হয়। কারণ গতরাতে আমি তিন কন্যা দেখেছি। আমার মনমানসিকতার তিন কন্যা। আমি শ্বাসের গন্ধ পাচ্ছি। শ্বাসের শব্দ ছুঁয়ে অনুভব করছি, জীবন। আমি ঘুম। ভাঙা পাখিদের সঙ্গে নিজের চোখ ঝাঁপটে স্বাগত জানাচ্ছি, সকালকে। আমি বেঁচে আছি।
আজ আমি এই তরুণ সকালে এই সময়ের সাহসী তিন কন্যার কাহিনী বলছি। জগতের পঙ্কিল গণ্ডি কাটিয়ে উঠে যারা গোলাপ পেতে চায়। মানুষের সৌন্দর্য যাদের কাছে মানুষের চেয়ে বড়। সত্যের চেয়েও বড়-সত্যবাদিতা। দাম্পত্যের চেয়েও, তার কারণ।
১. প্রথমা
সেদিন দুর্গা পুজোর মণ্ডপে বসেছিলাম। পাশেই খালি চেয়ার আর এই চেয়ারে বসে যিনি হঠাৎ আমার কুশলাদি জানতে চাইলেন তিনি অনন্যা। তার সাথে আমার দেখা হলো প্রায় বছর তিনেক বাদে। ঢাক বাজানোর শব্দের মধ্যে তার এই সহসা উপস্থিতি। চোখে-মুখে নব উচ্ছলতা। ছিল নতুন প্রাণ, যা আগে দেখিনি। এ যেন তার ”কাক্ষিত নক্ষত্র দেখতে পারার উচ্ছলতা।” তিনি আমাদের পাড়ারই বৌ। বয়সে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। তা সত্ত্বেও আমি তাকে আপনি বলছি কারণ, সাহসে তিনি আমার চেয়ে ঢের বড়। জীবন সংগ্রামে তিনি আমার চেয়েও সংগ্রামী। প্রথা ভাঙায় তিনি অদ্বিতীয়া। কোন এক বিশেষ কারণে তাকে আমি খুঁজছিলাম। তার সম্পর্কে আমি যা শুনেছি তার সবটাই প্রথা ভাঙার।
সমাজের চোখে আঙুল দেখিয়ে বৈধব্যের এক মাস পর থেকেই তিনি ধুতি ছেড়ে ফের রঙিন পরেন। হাতে, কানে, গলায় অলঙ্কার। পাড়ার লোকেরা প্রতিবাদ করে বললো, দু’ভরি সোনা! এই সাজসজ্জা তোমার নয়। চারদিকের শাসন সত্ত্বেও তিনি নিজেকে সংস্কারের কারাগারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। বৈধব্যের শুরু থেকে অদম্য সাহসের সঙ্গে সমাজকে দেখালেন বুড়ো আঙুল। আর সমাজ তাই একদিন ওকে একঘরে করে দিয়ে বললো–বেশ্যা। ওরা এই সাহসী নারীকে নারী না বলে, বেশ্যা বললো। কারণটা বিশেষ। রঙিন ছাড়াও, স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই, তার ঘরে শহরের এক বড়লোক ব্যবসায়ীর আনাগোনা। অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর মতো ওরা। ঘর বন্ধ করে দেয় যখন-তখন। নবমীতে তখন পুজোর কলরব চলছে। ঢাক বাজছে গুরুম-গুরুম। এর মধ্যেই পাড়ার একটি বৌ আমার কানে ফিসফিস করলো। ওমা! খবরদার। ওর সাথে কথা নয়। ও খুব খারাপ মেয়েমানুষ। এক ভিনজাতের ছেলের সঙ্গে শরীর খাটায়। জানি ও কি বলতে চাইছে। বন্ধুত্ব থাকলেই কি বেশ্যা হয়! বন্ধু ছাড়া মানুষ কি বাঁচে! কথা না বললে! এই যে প্রতি বিকেলে ঐ কলতলায় বসে তোরা নিয়মিত ঝগড়া করিস এও তো একধরনের আড্ডা। শাশুড়ি, বৌয়ের গালাগালি এও একটি অভ্যেস। ঝগড়ার কলরবে, জানিয়ে দেয়া, বেঁচে আছি। বললাম ও যা করেছে, ভালো খুব ভালো। তোদের সে ক্ষমতা নেই। এই যে পরনিন্দে করছিস, এও বিলাসিতা। কথা বলে হালকা হওয়া। ওর এখন সেই মানুষই চাই। আর কেউ যদি তাকে সেটুকু দিয়ে থাকে, নিশ্চয়ই সে ভালো। ভালো-মানুষ। লাল পেড়ে শাড়ি পরা বৌদি মাথা নিচু করানো। সব মেনে নেয়ার চিহ্ন।
তার নাম রিনি। সুর্বাচন ওর একমাত্র ছেলে। সুর্বাচনের বয়স এখন আঠারো। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজে একবেলা খেয়ে ছেলেকে তিন বেলা খাইয়েছেন। ওকে নিয়মিত স্কুলে পাঠিয়েছেন। প্রাইভেট পড়িয়েছেন। আর প্রথম দিকে শহরেরই সেই বড়লোকের দেয়া টাকা দিয়ে সেলাই মেশিন কিনে, এনজিওর কাজ, (গৃহ আর শরীর অলঙ্করণ) রাতভর সেলাই করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। রিনির যুক্তি, আমি নিজে কষ্ট করবো কিন্তু সুর্বাচনকে কখনো ওর বাবার মতো কষ্ট করতে দেবো না।
ওর ইচ্ছে পুর্বাচন একদিন অনেক বড়মাপের মানুষ হবে। ভালো মানুষ হবে। এবং ভালো মানুষ হয়ে সে মানুষের ভালোমন্দগুলোকে নিজের ভালোমন্দ বলে ভাববে। যার ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই, সুর্বাচন দেবে। পথ্য নেই, দেবে। পথ্য আর ওষুধের অভাবে ক্যান্সারাক্রান্ত স্বামীর শেষ দিনগুলোর যন্ত্রণার কথা রিনির পাথর বুকে মরুভূমির ফসিলের মতো মরে শুকিয়ে আছে।
দিনদিনই রিনির সৌন্দর্য বাড়ছে। যৌবন উথলে উঠছে। ধুতির বদলে রঙিন। রিনির ঘরে শহরের সেই বিত্তশালীর আনাগোনা। একসঙ্গে ওরা চা খায়। আচ্ছা করে। গান গেয়ে ওঠে। ঘর থেকে হাসির শব্দ বাজে। আর সুখের যে-কোন শব্দ পেলে, পাড়ার বুড়ো শিশুদের অসময়ের ঘুম ভেঙে যায়। গালাগাল দিয়ে বলে ওঠে, বেশ্যা মাসি। হেরে বাইর না করলে এই পাড়ায় মান সম্মানে থাকন যাবো না। রিনি ওসব গালমন্দ বাক্যবাণ নীরবে সহ্য করে যায়। তার তো কারো কাছে হাত পাততে হয় না। ওদের কাছে হাত পাতা, শরীর বিছিয়ে দেয়া থেকেও নরক।
রিমি একঘরে। রিমি সমাজ-বিচ্যুত। ওর দোষ মতিনের সঙ্গে সে মাগ-ভাতারে, থাকে। আমি সেই ফিসফিসকে বললাম, তাতে দোষের কি? মানুষের জীবনে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে কি বাকি জীবনের জন্যে তার সব সুখ চলে যাবে? যদি তাই হয় তাহলে মানুষ বাকি জীবন বাঁচে কি করে? ফিসফিস মেয়েটির মাথা আরো নুইয়ে পড়লো। যেন মস্ত ভুল করে ফেলে সে এখন অপরাধী। বড়লোকের সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হয়। ওকে দেখে মনে হলো, খুব বুঝেছে।