আমাদের জীবনযাত্রা প্রভাবিত হয় মূলত আমাদের সমাজ দ্বারা। সমাজের প্রচলিত অনিয়ম। মরচে ধরা সমাজের সেকেলে অবিচার। শ্বশুর-শাশুড়িসহ একান্নবর্তী পরিবার আমাদের। কিন্তু পরিবারের নববধূটির ওষ্ঠাগত প্রাণ। তার ওপর চাপানো সংসারের সব দায়িত্ব। তার ওপর পরীক্ষা আর পরীক্ষা। সতীত্বের পরীক্ষা, মাতৃত্বের, জরায়ুর। সকলের চাহিদা তারই ওপর। তাকেই বিয়ের নামে এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে স্থান বিচ্যুত করা হয়, এবং এনে তাকে কঠিন শাস্তি ও পরীক্ষার আগুনের সামনে নিক্ষেপ করা হয়। দজ্জাল শাশুড়ি। ননদ সাক্ষাৎ এক যম। স্বামী একজন জল্লাদ। আর ঘরে বসে তছবিহ্ গুণতে গুণতে সব কিছুতে ইন্ধন যোগান শ্বশুর। সব-সবাই-সবকিছু অচেনা। অজানা। রিক্ত।
অন্যদিকে স্ত্রীর প্রতারণা। যখন-তখন নারী স্বাধীনতার স্লোগান। মধ্য বয়সের জন্যে জমা হয়ে থাকে। ফোড়া, যেমন পুঁজ হতে হতে এক সময় ফেটে বেরোবেই। মধ্য বয়সে, অতীতের যত পুঁজ, বহুমুখী ফোড়ার মতো, ফেটে বের হবেই। পুঁজের সেই থলে খালি হলে, সে নতুন করে কি দিয়ে ভরবে পুঁজ না অমৃত, নির্ভর করে তার জীবনের আকাশে তখন চন্দ্রোদয় নাকি চন্দ্ৰাস্ত। যদি চন্দ্রোদয় হয় ভালো। যদি উল্টো হয়, তবেই ডুববে তরী। নিভবে বাতি।
হেলে-খেলে অপচয় হয়েছে কত সময়! তখন অনুভব হয়নি। আজ হয়। ৪৫-এ হয়। অনুতাপ হয়। ফেলে এসেছে বলে অশ্রু হয়। অপচয় বলে গ্লানি হয়। নেই বলে আফসোস হয়। পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখে শূন্য হাত। যে গ্যাছে যা গ্যাছে। অতীতের সব–সব অতীত। নেই সে আর ফেরে না। আর ফিরবেও না। সে মৃত। অনুভূতি ফিরে এলো, কিন্তু সে নেই।
ইচ্ছে হয় তাকেও কবর থেকে উঠিয়ে ভালোবাসতে। তার প্রতি সকল অবিচার, অন্যায়, ক্রোধ! তাকে রেখে পতিতালয়ে যাওয়া, সেজন্যে তার অশ্রু। তাকে অবজ্ঞা। তাকে দুঃখ দেয়। আজ কবরে বসে স্রেফ অশ্রু ছাড়া কিছু নেই।
ইচ্ছে হয় তাকে কবর থেকে উঠিয়ে ভালোবাসতে। তার প্রতি সকল অবিচার, অন্যায়, ক্রোধ। তাকে রেখে পরকীয়া, সেজন্য স্বামীর অশ্রু, তাকে অবজ্ঞা। তাকে দুঃখ। দেয়। আজ কবরে বসে শুধু অশ্রু ছাড়া কিছু নেই। সবই ফিরে এসেছে। কিন্তু হায়, সে কোথায়? যার জন্য সমাজ ত্যাগ, পালিয়ে আসা যার হাত ধরে, তার সঙ্গে দশ বছর জীবনযাপনের পর, বিবাহ বিচ্ছেদ। পরকীয়া।
দূরত্ব, নিঃসঙ্গতা –দু’জনকে আবার এক করে। দূরত্ব নিঃসঙ্গতা দু’জনকে দুই করে। মতামত, ব্যক্তিত্ব, ঐশ্বর্য, যোগ্যতা, মানুষকে দূর করে। মানুষকে এক করে। জীবনের ট্রেনের ৪৫ নম্বর প্লাটফর্মে পৌঁছে মল্লিকাঁদের প্রথম অনুভব হয় ছুটে পালিয়ে বাঁচতে। আর নয় স্বামী নামের এক দানবের অত্যাচার! এতকাল যাতে অভ্যস্ত, এখন তাতে বিদ্রোহ।
৩. সামাজিক অবকাঠামো
আমাদের সামাজিক অবকাঠামো, নির্দেশ করে আমাদের মধ্য বয়সের ঋতু। শুষ্ক ঝোড় না বসন্ত। দুঃসংবাদ যে, আমাদের সামাজিক অবকাঠামোগুলো আধুনিকতার কাছে এতই অবৈজ্ঞানিক, এতই বাতিল বলে গণ্য হয়, যে কারণে আমাদের জীবন হয় দুর্বিষহ। তথাকথিত বিজ্ঞজনেরাও এই পঙ্কিলতার বৃত্ত থেকে বাইরে নয়। বরং যত বেশি বিজ্ঞ, ধর্মান্ধতা, সমাজন্ধতা, সংস্কারন্ধতা তত বেশি।
গ্রামে-গঞ্জে মূলত একান্নবর্তী পরিবার ও নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত পরিবার। নিম্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবার। এই পরিবারগুলোতে ছেলের বৌয়ের অপমৃত্যুর হার অনেক। তার কারণ–একান্নবর্তী পরিবারের সকল কুসংস্কার। শাশুড়িজনিত কষ্ট, স্বামীর তাচ্ছিল্য ও অত্যাচার; এসব সংসারে একটা সুস্থ মানুষকে করে তোলে অসুস্থ। একান্নবর্তী পরিবার একটি অসুস্থ জায়গা, যেখানে সংসারের নামে চলে জল্লাদখানা। নারীর অধিকার, স্বাধীনতা কিভাবে হরণ করতে হয় জানতে হলে এখানে আসতে হয়।
একটা সমুদ্রে ঝরে যায় কত খড়কুটো, ডালপালা, ছেঁড়া কাগজ, কত হারানো মণিমাণিক্য। ভেসে যায় কত জেলে নৌকো, তারুণ্যের কত নৌবিহার! আর জীবন! সেতো পৃথিবীর সব-জল একত্র করলে, তার চেয়েও বড় সমুদ্র। অথচ এই সমুদ্রকে সঙ্কীর্ণ মনের মানুষেরা কল্পনা করে পুকুর। এখানে ঘটে-যাওয়া কোনও ব্যতিক্রমকে আমরা বলি অসামাজিক। আমরা কি আসলেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে অন্ধ হয়ে যাইনি?
কত সমস্যাই ঘটে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। সুখ সে আর কতটুকু! হাসি সে আর কতক্ষণ! পূর্ণতা সেও ক্ষণজীবী! তাহলে!
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আমাদের হাসি, সুখ, পূর্ণতাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। ফলে আমরা যথেষ্ট হাসতে পারি না, সুখী হতে পারি না, পূর্ণ হই না।
৪. দাম্পত্য দুঃখ-সুখ
সার্বক্ষণিক বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দাম্পত্য সুখ একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। সকল সমস্যার মধ্যেও এই সুখটুকু যদি আমাদের থাকে, তাহলে অন্য সব অসুখ একসঙ্গে বয়ে নেয়া সহজ হয়। কিন্তু দাম্পত্যের এই সুখটুকুই বড় বেশি ঝোড়ো হাওয়ার সম্মুখীন। এর কারণ ব্যাখ্যার অতীত। দু’জন দুই মানুষ। দুই মতবাদ। দুই ব্যক্তিত্ব। দুই ভালো-মন্দের। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিস্তর মতানৈক্য, বিবাদ, চরম হতাশা, নিষ্ঠুরতা সুখের বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দাম্পত্য ভাঙার কারণের শেষ নেই।
এমতাবস্থায় কি করা উচিত যখন নপুংসক স্বামীর পাশে শুয়ে সখিনা, বছরের পর বছর অতৃপ্ততার কষ্ট পেয়ে বৃদ্ধ হলো! কিন্তু কোনদিনও কাউকে সে জানায়নি তার দুঃসহ কষ্ট! এই সমাজে এসব জানানোর কারণ নেই, ভাষাও নেই। নিরক্ষর সখিনার অর্ধেক জীবন কাটালো–অর্ধপাগল। পাগলা গারদ।