লেখকের স্ত্রী বই বোঝে না। শিল্পীর স্বামী, তৈলচিত্রের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলে, তেল কই? দার্শনিকের ধর্মভীরু স্ত্রী, দর্শনের বইগুলোকে ফেলে দিয়ে সেখানে বোখারী শরীফ তুলে রাখে। একথা প্রমাণিত যে গুণীজনদের জীবনে ক্রাইসিস বড় বেশি, বিশেষ করে তাদের মিডলাইফ ক্রাইসিস। অধিকাংশেরই পা–ঘরের বাইরে। ওদের ঠেকাবে কে?
০৮. দাম্পত্য, সমাজ, সংসার
১. মধ্য বয়সের নিক্তি
বিশ্ব সংসারে আমাদের সৃষ্ট নানাবিধ সাংসারিক সামাজিক সঙ্কট যার দায়ভার পরবর্তীকালে আমাদেরই বইতে হয়। আমরা সৃষ্টি করি সংসার। তার কারণ আমরা সামাজিক জীব। সৃষ্টি করি সন্তান। সংসার ও সন্তান থাকলে থাকবে অর্থনৈতিক বিষয় আশয়গুলো। সংসারের ঘানিতে চাহিদা থাকে। থাকে দায়িত্ব। সেগুলো মেটাতেই হয়। আর থাকে দাম্পত্য, যা থাকলে তার সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী থাকবে কলহ। থাকে অভিযোগ।
স্বামী-স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়ি দেবর, ননদ, ননদাই, জেঠা, খুড়ো, তালতো ভাই, বেয়াই …। সব নিয়েই তো সমাজ! সমাজ আছে বলে আছে সামাজিকতা। পালন করলে অনেক বড়। না করলে কিছুই নয়। সমাজ বলে বিশাল এক বাধ্যবাধকতা আছে, যার কারণে চাইলেও ভালো থাকা থেকে, স্বাধীন জীবনযাপন থেকে পেছনে পড়ি, পিছিয়েও পড়ি। সংসারে কত রকম নিয়ম-যৌক্তিকতা। পালন না করলে, নেই। করলে অনেক কিছু। আবার না করলে–হায়-হায়! ও করলো না! কেন করলো না! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে! কেন কি হয়েছে! কি হয়েছে! খোঁজ! খোঁজ! ওর পেছনে কতগুলো ছিদ্র, কতবড় ঘা ওর গুহ্যদ্বারে। এটাই সত্যি এবং এর সবই আমাদের বোধের অক্ষমতা! দায়ভার। বোধ, যা বুদ্ধির উঁচু বা নিচু স্তরের, থার্মোমিটার।
জীবনের সকল সঙ্কটের পুঞ্জীভূত ও পরিপূর্ণ মেঘ যে আকাশে, তার কেন্দ্রবিন্দু হয় আমাদের মধ্য বয়স! কেন এবং কি এই মধ্য বয়স? আর এই বয়সে কেন, অতীতের ফেলে আসা বা আগামীর আকণ্ঠ সঙ্কটের সকল ভার এসে মুখ থুবড়ে পড়ে? কিসের এ ভারসাম্যহীনতা এই ‘৪৫’-এ! প্লাস-ও মাইনাস, ফাঁইভ। মানুষ যদি গড়ে নব্বই বছর বাঁচতো, তবে ৪৫-কে বলা যেতো নিক্তির মধ্যস্থলের কাঁটা, যেখানে ডাইনে–বায়ে মিলে ওজনের একটা ভারসাম্যতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু মানুষের গড়পড়তা আয়ু তো মাত্র ৫৫ থেকে ৭০। কিন্তু বাস্তবে ৪৫-এর আশপাশে ভিড়েই মানুষ প্রথমে নড়ে ওঠে তার সমগ্র অস্তিত্ব নিয়ে। তার অতীত তার ভবিষ্যৎ এবং তার বর্তমান। এবং এই ৪৫-এর প্রকৃত অর্থ হতে পারে মৃত্যুর সময় কতটা বাকি তার চেয়েও বরং জীবনের পথ কতটা পেরিয়ে এলাম। এবং ফেলে আসা পথের সকল ভুল-ভ্রান্তি ফিরে দেখা। অতীতের কত জানা-অজানার ভুল থেকে উদ্বুদ্ধ পরিতাপ। দাম্পত্য, শরীর, মন, সমাজ, সন্তান, অর্থ সম্পদ, ধর্ম সব ভারের প্রভাব এসে এখানেই ঘাঁটি গাড়ে। খুঁটি শক্ত হলে সে ভার টেকে। না হলে নড়ে যায়।
২. পাল্টানো জীবনের মোড়
মধ্য বয়স, জীবনের মোড় পাল্টানোর শুরু এখান থেকেই। পথ পরিবর্তন, বিকল্প, বিচ্যুতি, বিধ্বস্ত, গড়ে ওঠা, সূর্যাস্ত, চন্দ্ৰাস্ত-এখানেই। সব এখানেই। যাকে ভালো লেগেছে এতকাল, সেই দাম্পত্য আর ভালো লাগে না। এখন ভালো লাগে অন্য একজনের ঠোঁট, কি চিবুকের গাঢ় তিল। কৃষ্ণকালো চোখ কিংবা তার শাড়ির আঁচলের পাটপাট ভাঁজ। আগে, সপিং মল না হলে মাতালের নেশা না জমার মতো গা বমি বমি লাগতো। আজকাল বরং শুনলে, গা বমি বমি লাগে। আগে লাগতো শহর, এখন গ্রাম। লাগতো গ্রাম, এখন শহর। আগে মাসে একবার সঙ্গমেই হাঁপিয়ে উঠতো আর ৪৫-এ পৌঁছে মনে হয় আহা কত প্রেম! কতরূপ তেরা মাস্তানা! কত কাভি কাভি মেরে দিল মে! মনে বসন্ত আর চোখে সবুজ। তার চোখে সে সুচিত্রা সেন। তার চোখে সে উত্তম কুমার। ওকেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ। মনে হয় কবি নজরুল। বিছানায় নিজেকে মনে। হতো জন্তু! এখন মনে হবে নপুংসক। আগে যেতো বেশ্যালয়; এখন মন্দির-মসজিদ। ক্লাব ছেড়ে দিয়ে হজ। মন্ত্রিত্বেও সুখ নেই। উল্টো মনে পড়ে মায়ের কবর। পেশার চেয়ে ভালো লাগে নেশা। মাছ ধরা, নৌবিহার। সন্তানকে মনে হবে অভিশাপ, মনে হবে বন্ধু। মুখ দিয়ে মিথ্যে বেরোত না। কিন্তু অসদাচরণ এমন পেয়ে বসলো যে টাকার লোভে বা পরকীয়ায় এক মিথ্যে লুকোতে সহস্র মিথ্যে। একসময় মিথ্যে বলতে বলতে মিথ্যেও আর রোচে না। টাকার লোভ–সেখানেও ক্লান্তি এসে যায়।
অতীতের ছলচাতুরি প্রতারণা সে অভ্যেসেও মোড় ঘোরে। বা অতীতের সৎ-সাধু জীবন, ছলচাতুরি প্রতারণার প্রভাবে সিক্ত হয়। জীবনের রুপোর কাঠি-সোনার কাঠি, দিক পাল্টায়। যে নেশাখোর ঢোকে ঢোকে শ্বাসের সঙ্গে মদ গিলতো, তার ভালো লাগে শুষ্কতা। জীবনে যে ছোঁয়নি, প্রয়োজনে সে পচা পান্তার বাংলা গিলতে হরিজন পল্লী ছুটে যায়। ইচ্ছে হয় নতুন বন্ধনের। নব বন্ধুত্ব। কামনা হয় নব্য শরীর। বদল হয় দাম্পত্য রুচি। জাগে নতুন অনুভূতি পুরুষে, নারীতে। জাগে মাতৃত্বে। চেতনা হয়। অতীতের অবহেলা থেকে। নতুন দায়িত্ব কর্তব্যবোধ এসে শির উঁচু করে দাঁড়ায়, ক্ষতিপূরণ চেয়ে। সকল দায়িত্ব কর্তব্যবোধ পালন করতে গিয়ে নিজের প্রতি চরম অবহেলা। নিজেকে খুইয়ে, সংসার,অন্যের প্রভাবে নিজের সব খুইয়ে মানসিক ও বৌদ্ধিক যন্ত্রণা–সব এখানেই, এই ৪৫-এই। এখানে ভারসাম্যতার নিক্তি ডাইনে বায়ে দুলতে থাকে।