ঘ. আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু সম্ভাবনা থাকে। থাকে সক্ষমতা। কেউ তাকে সাহসের সাথে উন্মুক্ত করতে পারে। কেউ তাকে অজুহাত দিয়ে উড়িয়ে দেয়। কেউ ভয়ভীতি দিয়ে ঢেকে রাখে। অধিকাংশ মানুষই তাদের সক্ষমতাকে ভয় পায়। প্রতিভা অপচয়ের ব্যাখ্যায় সংসারের অজুহাতের জুড়ি নেই। এ কারণ, সে কারণ। কতই না কারণ আমাদের অজুহাতের! ছেলের অজুহাত, মেয়ের অজুহাত সংসারের অজুহাত। কিন্তু সময় কাউকে ক্ষমা করে না। এবং অলস সময়গুলো, বয়স গিলে খাওয়ার সাথে সাথে মনের অধঃপতনকে দ্রুত করে। মন, যা পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় রহস্য। মন, যার কোনও বসতি নেই, পরিচয় নেই, ঠিকানাও নেই। মন, যা সকালের আবহাওয়ায় যেমন থাকে, দুপুরে থাকে না। যা প্রতিদিন এক পোশাকে থাকে না। প্রতিটি সকাল এক মনে হয় না। কখনো দুঃখ, কখনো সুখ কোন কারণ ছাড়াই। সন্ধেবেলায় পুকুর পাড়ে নির্জনে বসলে যেমন লাগে, কোলাহলে তেমনটা লাগে না। টিন-ইজ মনের সঙ্গে মধ্য ত্রিশের মনের সম্পর্ক আলাদা। সন্ন্যাসীর আলাদা। গৃহীর আলাদা। পথিকের আলাদা। জীবনের প্রকৃত অনুভূতিগুলোকে একমাত্র সৃষ্টিশীল মনই যথার্থ ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে পারে। সুতরাং ‘বন’ রক্ষার মতো ‘মন’ রক্ষাও জরুরি। এবং সৃষ্টিশীলদের মনের বেলায়, এখানে কোনওরকম হস্তক্ষেপ কিংবা প্রভাব –নিষিদ্ধ।
স্বামী, স্ত্রীর প্রভাবে, স্ত্রী স্বামীর। সংসারে আমাদের চিন্তাধারাগুলো অন্যের রুচি ইচ্ছা-ফরমায়েশে চলে। অন্যের বা অন্য কিছুর প্রভাব সৃষ্টিশীল মানুষদের সৃষ্টির মৌলিক চিন্তার বিরুদ্ধে কাজ করে। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হলে, মৌলিক চিন্তাগুলো হারিয়ে সে নিঃস্ব হতে পারে। অনুভূতি তখন আর অনুভবে সীমাবদ্ধ থাকে না। এবং তা গতি পরিবর্তন করে রূপান্তরিত হয় দায়িত্বে। দায়িত্ব, অন্যের প্রতি। এবং এর ভেতর থেকে যা সৃষ্টি হবে–তা ঘুণে ধরা। তা মৌলিক নয়। যা মৌলিক নয়, তা সৃষ্টি না করাই ভালো। নিরঙ্কুশ নিঃশর্ত নিঃসঙ্গ না হলে, সেই সৃষ্টির মূল্যও নেই। সেই সৃষ্টিও, দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। সেজন্যেই অপসৃষ্টি বা কু-সৃষ্টি দিয়ে বাজার ভরে গেছে। অনেকটা অক্ষম অনুবাদ সাহিত্যের মতো। অন্যের জিনিস, অন্যের চিন্তার, অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রয়াসে, বিকৃত রূপান্তর।
নিজের চিন্তায় নিজে বিকশিত হতে হলে অন্যের প্রভাব সেখানে টিকতে পারে না। টিকলেই সংঘাত, সৃষ্টির সঙ্গে ব্যক্তির। শূন্যতার সঙ্গে ব্যক্তির। নিঃসঙ্গ নির্বাসনের সঙ্গে ব্যক্তির। সময়ের সঙ্গে ব্যক্তির। সময়, আগেও বলেছি কাউকে ক্ষমা করে না। সময় নিষ্ঠুর নিঃসন্দেহে। এবং তা অপচয়ের যন্ত্রণা, সৃষ্টিশীল মানুষদের মধ্যে প্রথম আসে মধ্য বয়সে। তখন তারা মদ-গাঁজা-ভাং ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচে।
ঙ. সংসার বাদি আর সংসার বিবাদি। সাংসারিক মানুষগুলোর সঙ্গে প্রচণ্ড তর্ক তোলা যায়। ধরা যাক, ওদের বিশ্বাস, কেউ কেউ ভণ্ড, নীতিহীন সমাজসংস্কারক। সংসারে থেকেও, যতটা স্বাধীন ও সৃষ্টির ক্ষমতা ভোগ করা যায় তারা তা না। সুতরাং সে মানুষটি পথবিচ্যুত তো বটেই বিভ্রান্ত বলেই সংসারের বিরুদ্ধে ওকালতি করছে। এই সব সংসারী মানুষগুলোর জন্যে সত্যিই সবার করুণা হওয়া উচিত। ওরা সেসব কথা ধরতে না পেরে, শুধু তর্কই করে গেল। অথচ এদের প্রায় প্রত্যেকেরই যথেষ্ট শিক্ষিত বলে সমাজে পরিচিতি আছে। ওরা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারত। কিন্তু করলো না। যা করলো তা–সমঝোতা, সংসার-দায়িত্ব আর সময়ের সঙ্গে। ওরা উপভোগের উপাসক। তবে মধ্য বয়সে পৌঁছে এই সংসারী মানুষেরা প্রথম বুঝতে পারে পৃথিবীতে তাদের কিছু না রেখে যাওয়ার ব্যর্থতা। এই প্রথম তারা অনুভব করে তারা এমন এক বৃক্ষ, যাদের বুড়ো হওয়া ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই।
আমাদের দিনের সমস্যা মিটিয়ে রাত আসে। আর রাতের সমস্যা মেটাতে মেটাতে হয়ে যায় সকাল। আমরা সমস্যাপ্রিয়। সমস্যা না থাকলে, সৃষ্টি করি। একটা সন্তান থাকলে, দুটো। একটা ঘর হলে, তিনটে। এক জোড়া থাকলে, নজোড়া। চেয়ারম্যান হতে পারলে সাংসদ। সংসদে পৌঁছুলে মন্ত্রিত্ব। মন্ত্রী হলে দেশের সর্বোচ্চ মন্ত্রীর পদটি। আমাদের, চাওয়া-পাওয়ার, সমস্যার, কোনও আদি-অন্ত নেই। অনেকটা তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। আমাদের আরো চাই, চেয়ে চেয়ে শুধু কাঙাল হতে। সুতরাং, চাহিদা আর সমস্যা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট। আমরা পরাধীন অনেক কিছুর কাছে। যা করি তা অন্যের জন্যে, তা অন্যের ইচ্ছায়। অনুতাপ একদিন আসবেই। তবে তা প্রথম এবং প্রখরভাবেই আসে, মধ্য বয়সে। কিন্তু তখন, সৃষ্টির মতো মন বা ইচ্ছা কোনও কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না।
চ. সবশেষে, আমার অনুভূতি। আমার সন্দেহ হয় যে, মধ্য বয়স এমন একটা সময় যেখানে এসে আমার মতে সৃষ্টিশীল স্বামী বা স্ত্রীর মুক্ত হওয়া উচিত একে অন্যের স্বত্বাধিকার থেকে। যৌবনে সয়েছে তবে, জীবনের এই পর্যায়ে পৌঁছে, নারী বা পুরুষ উভয়েই নিজেরা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। এবং নিজের মতো করে। যা চাইলেও সে এতকাল পারেনি। মধ্য বয়সে এসে জেগে ওঠে নারীর স্বাধীনতার তীব্রতা। আর নারীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে আগে বাদ সাধে পুরুষ। মধ্য বয়সী পুরুষ। তার ইচ্ছে অনুভূতি স্বাধীনতা ও অধিকার, পুরুষ নিয়ন্ত্রণ করে। আর তার সৃষ্টির আগুন যা বিয়ের পরপর পুরুষই তা নিভিয়ে দিয়েছে আবার রুখে দাঁড়ায়।