বাপ নাকি? জগমোহন বলে ব্যঙ্গ করে। বাপ না? মণ্ডল দশটা গাঁয়ের বাপা খালি জম্মো দিলেই বাপ হয় না, অন্ন দিলেও হয়। মণ্ডল আমাগো অন্ন দিছে। আমাগো বুঝাইছে, সাহস দিছে, একসাথ করছে, ধান কাটাইছে। না তো চণ্ডী ঘোষ নিত বেবাক ধানা তোমারে কই জগু, হাতে ধইরা কই, বুইঝা দ্যাখো, মিছা গোসা কইরো না।
বুইঝা কাম নাই। অখন যাই।
রাইতটা থাইকা যাও। জামাই আইলা, গেল। গিয়া, মাইনষে কি কইব?
জামাইয়ের অভাব কি। মাইয়া আছে, কত জামাই জুটবো।
বেলা শেষ হতে না হতে ঘনিয়ে এসেছে শীতের সন্ধ্যা অল্প অল্প কুয়াশা নেমেছে। খুঁটের ধোঁয়া ও গন্ধে নিশ্চল বাতাস ভারি। যাই বলেই যে গা তোলে জগমোহন তা নয়। ময়নার মারও তা জানা আছে যে শুধু শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করে যাই বলেই জামাই গট গট করে বেরিয়ে যাবে না। ময়নার সাথে বোঝাপড়া, ময়নাকে কাঁদানো, এখনো বাকি আছে। যদি যায় জামাই, মেয়েটাকে নাকের জলে চোখের জলে এক করিয়ে তারপর যাবে। আর কথা বলে না ময়নার মা, আস্তে আস্তে উঠে বেরিয়ে যায় বাড়ী থেকে। ঘরে কিছু নেই, মোয়ামুড়ি কিছু যোগাড় করতে হবে। খাক বা না খাক সামনে ধরে দিতেই হবে জামাইয়ের।
চোখ মুছে নাক ঝেড়ে ময়না বলে ভয়ে ভয়ে, ঘরে আস।
খাসা আছি। শুইছিলা তো?
না, মা কালীর কিরা, শুই নাই। মার কওনে খালি ঝাঁপটি দিছিলাম, বাঁশটাও লাগাই নাই।
ঝাঁপ দিছিলা, শোও নাই। বেউলা সতী!
ময়না তখন কাঁদে।
তোমার লগে আইজ থেইকা শেষ।
ময়না আরও কাঁদে।
ঘর থেকে হারাণ কাঁপা গলায় হাঁকে, আসে নাই? ছোঁড়া আসে নাই? হায় ভগবান! থেমে থেমে এক একটা কথা বলে যায় জগমোহন, না থেমে অবিরাম কেঁদে চলে ময়না, যতক্ষণ না কান্নাটা একঘেয়ে লাগে জগমোহনের। তখন কিছুক্ষণ সে চুপ করে থাকে। মুড়িমোয়া যোগাড় করে পাড়া ঘুরে ময়নার মা যখন ফিরে আসে, ময়না তখন চাপা সুরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। বেড়ার বাইরে সুপারি গাছটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে ময়নার মা সারাদিন পরে এখন তার দু’চোখ জলে ভরে যায়। জোতদারের সাথে, দারোগা পুলিশের সাথে লড়াই করা চলে, অবুঝ পাষণ্ড জামাইয়ের সাথে লড়াই নেই!
আপন মনে আবার হাঁকে হারাণ, আসে নাই? মোর মরণটা আসে নাই? হায় ভগবান!
জগমোহন চুপ করে ছিল, এতক্ষণ পরে হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করে শালার খবর। —উয়ারে ধরছে ক্যান?
ময়নার কান্না থিতিয়ে এসেছিল, সে বলে, মণ্ডলখুড়ার লগে গোঁদল পাড়া গেছিল, ফিরতি পথে একা পাইয়া ধরছে।
ক্যান ধরছে?
কাইল জব্দ হইছে, সেই রাগে বুঝি।
বসে বসে কি ভাবে জগমোহন, আর কাঁদায় না ময়নাকো ময়নার মা ভেতরে আসে, কাঁসিতে মুড়ি আর মোয়া খেতে দেয় জামাইকে, বলে, মাথা খাও, মুখে দাও।
আবার বলে, রাইত কইরা ক্যান যাইবা বাবা? থাইকা যাও।
থাকনের বোনাই। মা দিব্যি দিছে।
তবে খাইয়া যাও? আখা ধরাই? পোলাটারে ধইরে নিছে, পরাণ পোড়ায়। তোমারে রাইখা জুড়ামু ভাবছিলাম।
না, রাইত বাড়ে।
আবার কবে আইবা?
দেখি।
উঠি-উঠি করেও দেরি হয়। তারপর আজ সন্ধ্যারাতেই পুলিশ হানার সেইরকম সোর ওঠে কাল মাঝরাত্রির মতো। সদলবলে মন্মথ আবার আচমকা হানা দিয়েছে। আজ তার সঙ্গের শক্তি কালের চেয়ে অনেক বেশী। তার চোখ সাদা।
সোজাসুজি প্রথমেই হারাণের বাড়ী।
কি গো মণ্ডলের শাশুড়ী, মন্মথ বলে ময়নার মাকে, জামাই কোথা?
ময়নার মা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
এটা আবার কে?
জামাই ময়নার মা বলে।
বাঃ, তোর তো মাগী ভাগ্যি ভাল, রোজ নতুন নতুন জামাই জোটে। আর তুই ছুঁড়ি এই বয়সে–
হাতটা বাড়িয়েছিল মন্মথ রসিকতার সঙ্গে ময়নার থুতনি ধরে আদর করে একটু নেড়ে দিতো। তাকে পর্যন্ত চমকে দিয়ে জগমোহন লাফিয়ে এসে ময়নাকে আড়াল করে গর্জে ওঠে, মুখ সামলাইয়া কথা কইবেন!
বাড়ীর সকলকে, বুড়ো হারাণকে পর্যন্ত, গ্রেফতার করে আসামী নিয়ে রওনা দেবার সময় মন্মথ দেখতে পায় কালকের মতো না হলেও লোক মন্দ জমেনি। দলে দলে লোক ছুটে আসছে চারিদিক থেকে, জমায়েত মিনিটে মিনিটে বড় হচ্ছে। মথুরার ঘর পার হয়ে পানা পুকুরটা পর্যন্ত গিয়ে আর এগোনো যায় না। কালের চেয়ে সাত-আটগুণ বেশী লোক পথ আটকায়। রাত বেশী হয়নি, শুধু এগাঁয়ের নয়, আশেপাশের গাঁয়ের লোক ছুটে এসেছে। এটা ভাবতে পারেনি মন্মথ। মণ্ডলের জন্য হলে মানে বোঝা যেত, হারাণের বাড়ীর লোকের জন্য চারদিকের গাঁ ভেঙে মানুষ এসেছে! মানুষের সমুদ্র, ঝড়ের উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে লড়া যায় না। ময়না তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়েই রক্ত মুছিয়ে দিতে আরম্ভ করে জগমোহনের। নব্বই বছরের বুড়ো হারাণ সেইখানে মাটিতে মেয়ের কোলে এলিয়ে নাতির জন্য উতলা হয়ে কাঁপা গলায় বলে, ছোঁড়া গেল কই? কই গেল? হায় ভগবান!