গাঁয়ের মেয়েরা আসে দলে দলে, অনিশ্চিত আশঙ্কা ও সম্ভাবনায় ভরা এমন যে ভয়ঙ্কর সময় চলেছে এখন, তার মধ্যেও তারা আজ ভাবনা-চিন্তা ভুলে হাসিখুশিতে উচ্ছল।
মোক্ষদার মা বলে একগাল হেসে গালে হাত দিয়ে, মাগো মা, ময়নার মা, তোর মদ্যি এত?
ক্ষেন্তি বলে ময়নাকে, কিলো ময়না, জামাই কি কইলো? দিছে কি?
লাজে ময়না হাসে।
বেলা পড়ে এলে, কাল যে সময় ভুবন মণ্ডল গাঁয়ে পা দিয়েছিল প্রায় সেই সময় আবির্ভাব ঘটে জগমোহনের। বয়স তার ছাব্বিশ-সাতাশ, বেঁটে খাটো জোয়ান চেহারা, দাড়ি কামানো, চুল আঁচড়ানো। গায়ে ঘরকাচা শার্ট, কাঁধে মোটা সুতির সাদা চাদর গাঁয়ে ঢুকে গটগট করে সে চলতে থাকে হারাণের বাড়ীর দিকে, এপাশ ওপাশ না তাকিয়ে, গম্ভীর মুখে।
রসিক ডাকে দাওয়া থেকে, জগমোহন নাকি? কখন আইলা?
নন্দ বলে, আরে শোন শোন, তামুক খাইয়া যাও।
জগমোহন ফিরেও তাকায় না।
রসিক ভড়কে গিয়ে নন্দকে শুধোয়, এই কাণ্ড বুঝলা নি?
কেমনে কমু?
অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দু’জনন।
পথে মথুরের ঘর। তার সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠতা আছে জগমোহনের নাম ধরে হাঁক দিতে ভেতর থেকে সাড়া আসে না, বাইরের লোক জবাব দেয়। ঘরের কাছেই পথের ওপাশে একটা তালের গুড়িতে দু’জন মানুষ বসে ছিল নির্লিপ্তভাবে, একজনের হাতে খোঁটা সুদ্ধ গরু-বাঁধা দড়ি
তাদের একজন বলে, বাড়ীতে নাই। তুমি কেডা, হারামজাদারে খোঁজ ক্যান?
জগমোহন পরিচয় দিতেই দুজন তারা অন্তরঙ্গ হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে।
অ! তুমিও আইছ ব্যাটারে দুই ঘা দিতে?
তা ভয় নেই জগমোহনের, তারা আশ্বাস দেয়, হাতের সুখ তার ফসকাবে না। কাল সন্ধ্যায় গেছে গাঁ থেকে, এখনো ফেরেনি মথুর, কখন ফিরে আসে ঠিকও নাই, তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না জগমোহনকে। মথুর ফিরলে তাকে যখন বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে বিচারের জন্য, সে খবর পাবো সবাই মিলে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলার আগে তাকেই নয় সুযোগ দেওয়া হবে মথুরের নাক কানটা কেটে নেবার, সে ময়নার মা’র জামাই, তার দাবি সবার আগে।
শাউড়ী পাইছিলা দাদা একখানা!
নিজের হইলে বুঝতা জগমোহন জবাব দেয় ঝাঁঝের সঙ্গে। চলতে আরম্ভ করে। শুনে দুজনে তারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে অবাক হয়ে!
আচমকা জামাই এল, মুখে তার ঘন মেঘ দেখেই ময়নার মা বিপদ গণে। ব্যস্ত-সমস্ত না হয়ে হাসি মুখে ধীরে শান্তভাবে অভ্যর্থনা জানায়, তার যেন আশা ছিল, জানা ছিল, এ সময় এমনিভাবে জামাই আসবে, এটা অঘটন নয়। বলে, আস বাবা আস। ও ময়না, পিঁড়া দো ভাল নি আছে বেবাকে? বিয়াই বিয়ান পোলামাইয়া?
আছে!
আরেকটুকু ভড়কে যায় ময়নার মা। কত গোঁসা না জমা আছে জামাই-এর কাটা-ছাঁটা এই কথার জবাবে। ময়নার দিকে তার না-তাকাবার ভঙ্গিটাও ভাল ঠেকে না পড়ন্ত রোদে লাউমাচার সাদা ফুলের শোভা ছাড়া আর কিছুই যেন চোখ চেয়ে দেখবে না শ্বশুরবাড়ির, পণ করেছে জগমোহন! লক্ষণ খারাপ।
ঘর থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় হারাণ হাঁকে, আসে নাই? হারামজাদা আসে নাই?হায় ভগবান! নাতিরে খোঁজে, ময়নার মা জগমোহনকে জানায়, বিয়ান থেইকা দ্যাখে না, উতলা হইছে।
ময়নার মা প্রত্যাশা করে যে, নাতিকে হারাণ সকাল থেকে কেন দ্যাকে না, কি হয়েছে হারাণের নাতির, ময়নার ভায়ের, জানতে চাইবে জগমোহন, কিন্তু কোন খবর জানতেই এতটুকু কৌতূহল দেখা যায় না তারা
খাড়াইয়া রইলা ক্যান? বসো বাবা, বসো।
জগমোহন বসে ময়নার পাতা পিঁড়ি সে ছোঁয় না, দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে উবু হয়ে বসে।
মুখ হাত ধুইয়া নিলে পারতা।
না, যামু গিয়া অখনি।
অখনি যাইবা?
হ। একটা কথা শুইনা আইলাম। মিছা না খাঁটি জিগাইয়া যামু গিয়া। মাইয়া নাকি কার লগে শুইছিল কাইল রাতে?
শুইছিল? ময়নার মার চমক লাগে, মোর লগে শোয় মাইয়া, মোর লগে শুইছিল, আর কার লগে শুইব?
ব্রহ্মাণ্ডের মাইনষে জানছে কার লাগে শুইছিল। চোখে দেইখা গেছে দুয়ারে ঝাঁপ দিয়া কার লগে শুইছিল।
তারপর বেধে যায় শাশুড়ী-জামাইয়ে। প্রথমে ময়নার মা ঠাণ্ডা মাথায় নরম কথায় ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করে, কিন্তু জগমোহনের ওই এক গোঁ! ময়নার মাও শেষে গরম হয়ে ওঠো বলে, তুমি নিজে মন্দ, অন্যেরে তাই মন্দ ভাবো। উঠানে মাইনষের গাদা, আমি খাড়া সামনে, একদণ্ড ঝাঁপটা দিছে কি না দিছে, তুমি দোষ ধরলা! অন্যে তো কয় না?
অন্যের কি? অন্যের বৌ হইলে কইতো।
ড় ছোট মন তোমারা আইজ মণ্ডলের নামে এমন কথা কইলা, কাইল কইবা জুয়ান ভায়ের লগে ক্যান কথা কয়।
কওন উচিত। ও মাইয়া সব পারে।
তখন আর শুধু গরম কথা নয়, ময়নার মা গলা ছেড়ে উদ্ধার করতে আরম্ভ করে জগমোহনের চোদ্দপুরুষ হারাণ কাঁপা গলায় চেঁচায়, আইছে নাকি? আইছে হারামজাদা? হায় ভগবান আইছে? ময়না কাঁদে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ছুটে আসে পাড়াবেড়ানি নিন্দাছড়ানি নিতাই পালের বৌ আর প্রতিবেশী কয়েকজন স্ত্রীলোক।
কি হইছে গো ময়নার মা? নিতাই পালের বৌ শুধায়, মাইয়া কাঁদে ক্যান?
তাদের দেখে সম্বিৎ ফিরে পায় ময়নার মা, ফোঁস করে ওঠে,কাঁদে ক্যান? ভাইটারে ধইরা নিছে, কাঁদব না?
জামাই বুঝি আইছে খবর পাইয়া?
শুনবা বাছা, শুনবা। বইতে দাও, জিরাইতে দাও।
ময়নার মার বিরক্তি দেখে ধীরে ধীরে অনিচ্ছুক পদে মেয়েরা ফিরে যায়। তাকে ঘাঁটাবার সাহস কারো নেই। ময়নার মা মেয়েকে ধমক দেয়, কাঁদিস না। বাপেরে নিয়া ঘরে গেছিলি, বেশ করিছিলি, কাঁদনের কি?