বক্তৃতার ভঙ্গিতে সে জানায় যে, হাকিমের দস্তখতী পরোয়ানা নিয়ে সে এসেছে হারাণের ঘর তল্লাস করতো তল্লাস করে আসামী না পায়, ফিরে চলে যাবে। এতে বাধা দেওয়া হাঙ্গামা করা উচিত নয়, তার ফল খারাপ হবে। বে-আইনী কাজ হবে সেটা।
গফুর চেঁচিয়ে বলে, মোরা তল্লাস করতি দিমু না।
প্রায় দুশো গলা সায় দেয়, দিমু না!
এমনি যখন অবস্থা, সংঘর্ষ প্রায় শুরু হয়ে যাবে মন্মথ হুকুম দিতে যাচ্ছে গুলি চালাবার, ময়নার মার খ্যানখেনে তীক্ষ্ণ গলা শীতার্ত থমথমে রাত্রিকে ছিঁড়ে কেটে বেজে উঠল, রও দিকি তোমরা, হাঙ্গামা কইরো না। মোর ঘরে কোন আসামী নাই। চোর ডাকাইত নাকি যে ঘরে আসামী রাখুম? বিকালে জামাই আইছে, শোয়াইছি মাইয়া জামাইরে দারোগাবাবু তাল্লাস করতে চান তাল্লাস করেন।
মন্মথ বলে, ভুবন মণ্ডল আছে তোমার ঘরে?
ময়নার মা বলে, দ্যাখেন আইসা, তাল্লাস করেনা ভুবন মণ্ডল কেডা? নাম তো শুনি নাই বাপের কালো মাইয়ার বিয়া দিলাম বৈশাখে, দুই ভরি রূপা কম দিছি ক্যান, জামাই ফির্যা তাকায় না। দুই ভরির দাম পাঠাইয়া দিছি তবে আইজ জামাই পায়ের ধূলা দিছে। আপনারে কমু কি দারোগাবাবু, মাইয়াটা কাইন্দা মরো মাইয়া যত কান্দে, আমি তত কান্দি–
আচ্ছা, আচ্ছা। মন্মথ বলে, ভুবনকে না পাই, জামাই নিয়ে তুমি রাত কাটিও।
গৌর সাউ হেঁকে বলে, অত চুপে চুপে আসে কেন জামাই ময়নার মা?
গা জ্বলে যায় ময়নার মা-রা বলে, সদর দিয়া আইছে! তোমার একটা মাইয়ার সাতটা জামাই চুপে চুপে আসে, মোর জামাই সদর দিয়া আইছে।
গৌর আবার কি বলতে যাচ্ছিল, কে যেন আঘাত করে তার মুখে একটা আর্ত শব্দ শুধু শোনা যায়, সাপে-ধরা ব্যাঙের একটি মাত্র আওয়াজের মতো।
ময়নার রঙিন শাড়ী ও আলুথালু বেশ চোখে যেন ধাঁধা লাগিয়ে দেয় মন্মথর, পিচুটির মত চোখে এঁটে যেতে চায় ঘোমটা পরা ভীরু লাজুক কচি চাষী মেয়েটার আধপুষ্ট দেহটি। এ যেন কবিতা বি.এ. পাশ মন্মথর কাছে, যেন চোরাই স্কচ হুইস্কির পেগ, যেন মাটির পৃথিবীর জীর্ণক্লিষ্ট অফিসিয়াল জীবনে একফেঁটা টসটসে দরদ। তার রীতিমত আপসোস হয় যে জোয়ান মর্দ মাঝবয়সী চাষাড়ে লোকটা এর স্বামী, ওর আদরেই মেয়েটার এই আলুথালু বেশ!
তবু মন্মথ জেরা করে, সংশয় মেটাতে গাঁয়ের দু’জন বুড়োকে এনে সনাক্ত করায়। তার পরেও যেন তার বিশ্বাস হতে চায় না! ভুবন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে গায়ে চাদর জড়িয়ে যতটা সম্ভব নিরীহ গোবেচারী সেজে। কিন্তু খোঁচা খোঁচা গোঁপদাড়ি ভরা মুখ, রুক্ষ এলোমেলো একমাথা চুল, মোটেই তাকে দেখায় না নতুন জামায়ের মত মন্মথ গর্জন করে হারাণকে প্রশ্ন করে, এ তোমার নাতনীর বর?
হারাণ বলে, হায় ভগবান!
ময়নার মা বলে, জিগান মিছা, কানে শোনে না, বদ্ধ কালা।
আ! মন্মথ বলে।
ভুবন ভাবে এবার তার কিছু বলা বা করা উচিত।
এমন হাঙ্গামা জানলে আইতাম না কর্তা মিছা কইয়া আনছে আমারো সড়াইলের হাটে আইছি, ঠাইরেণ পোলারে দিয়া খপর দিলেন, মাইয়া নাকি মর মর, তখন যায় এখন যায়।
তুমি অমনি ছুটে এলে?
আসুম না? রতিভরি সোনা-রূপা যা দিব কইছিল, তাও ঠেকায় নাই বিয়াতে। মইরা গেলে গাও থেইকা খুইলা নিলে আর পামু?
ওঃ! তাই ছুটে এসেছ? তুমি হিসেবী লোক বটে। মন্মথ বলে ব্যঙ্গ করে।
আর কিছু করার নেই, বাড়ীগুলি তাল্লাস ও তছনছ করে নিয়ম রক্ষা করা ছাড়া। জামাইটাকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া চলে সন্দেহের যুক্তিতে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু হাঙ্গামা হবে। দু’পা পিছু হটে এখনো চাষীর দল দাঁড়িয়ে আছে, ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যায় নি। গাঁয়ে গাঁয়ে চাষাগুলোর কেমন যেন উগ্র মরিয়া ভাব, ভয় ডর নেই। ঘরে ঘরে তল্লাস চলতে থাকে একটা বিড়াল লুকানোর মতো আড়ালও যে ঘরে নেই, সে ঘরেও কাঁথা বালিস হাঁড়িপাতিল জিনিসপত্র ছত্রখান করে খোঁজা হয় মানুষকে।
মন্মথ থাকে হারাণের বাড়ীতেই। অল্প নেশায় রঙিন চোখা এ সব কাজে বেরোতে হলে মন্মথ। অল্প নেশা করে, মাল সঙ্গে থাকে কর্তব্য সমাপ্তির পর টানবার জন্য,—চোখ তার রঙিন শাড়ীজড়ানো মেয়েটাকে ছাড়তে চায় না। কুরিয়ে কুরিয়ে তাকায় ময়নার দিকে ময়নার কুড়ি বাইশ বছরের জোয়ান ভাইটা উসখুস করে ক্রমাগত ভুবনের চোখ জ্বলে ওঠে থেকে থেকে। ময়নার মা টের পায়, একটু যদি বাড়াবাড়ি করে মন্মথ, আর রক্ষা থাকবে না!
মেয়েটাকে বলে ময়নার মা, শীতে কাঁপুনি ধরেছে, শো’ না গিয়া বাছা? তুমিও শুইয়া পড় বাবা। আপনে অনুমতি দ্যান দারোগাবাবু, জামাই শুইয়া পড়ুক। কত মানত কইরা, মাথা কপাল কুইটা আনছি জামাইরে,—ময়নার মা’র গলা ধরে যায়। আপনারে কি কমু দারোগাবাবু–
ময়না ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ভুবন যায় না।
আরও দু’বার ময়নার মা সস্নেহে সাদর অনুরোধ জানায় তাকে, তবু ভুবনকে ইতস্তত করতে দেখে বিরক্ত হয়ে জোর দিয়ে বলে, গুরুজনের কথা শোন, শোও গিয়া। খাড়াইয়া কি করবা? ঝাঁপ বন্ধ কইরা শোও!
তখন তাই করে ভুবনা যতই তাকে জামাই মনে না হোক, এরপর না মেনে আর কি চলে যে সে জামাই?মন্মথ আস্তে আস্তে বাইরে পা বাড়ায়। পকেট থেকে চ্যাপ্টা শিশি বার করে ঢেলে দেয় গলায়।
পরদিন মুখে মুখে এ গল্প ছড়িয়ে যায় দিগদিগন্তে, দুপুরের আগে হাতীপাড়ার জগমোহন আর জোতদার চণ্ডী ঘোষ আর বড় থানার বড় দারোগার কাছে পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়। গাঁয়ে গাঁয়ে লোকে বলাবলি করে ব্যাপারটা আর হাসিতে ফেটে পড়ে, বাহবা দেয় ময়নার মাকে! এমন তামাশা কেউ কখনো করেনি পুলিশের সঙ্গে, এমন জব্দ করেনি পুলিশকে। ক’দিন আগে দুপুরবেলা পুরুষশূন্য গাঁয়ে পুলিশ এলে ঝাঁটা বঁটি হাতে মেয়ের দল নিয়ে ময়নার মা তাদের তাড়া করে পার করে দিয়েছিল গাঁয়ের সীমানা! সে যে এমন রসিকতাও জানে, কে তা ভাবতে পেরেছিল?