- বইয়ের নামঃ শ্রেষ্ঠ গল্প
- লেখকের নামঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ দি স্কাই পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অতসী মামি
যে শোনে সেই বলে, হ্যাঁ, শোনবার মতো বটে!
বিশেষ করে আমার মেজমামা। তার মুখে কোনো কিছুর এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা খুব কম শুনেছি।
শুনে শুনে ভারী কৌতুহল হল। কী এমন বাঁশি বাজায় লোকটা যে সবাই এমনভাবে প্রশংসা করে? একদিন শুনতে গেলাম। মামার কাছ থেকে একটা পরিচয়পত্র সঙ্গে নিলাম।
আমি থাকি বালিগঞ্জে, আর যাঁর বাঁশি বাজানোর ওস্তাদির কথা বললাম তিনি থাকেন ভবানীপুর অঞ্চলে। মামার কাছে নাম শুনেছিলাম, যতীন। উপাধিটা শোনা হয়নি। আজ পরিচয়পত্রের উপরে পুরো নাম দেখলাম, যতীন্দ্রনাথ রায়।
বাড়িটা খুঁজে বার করে আমার তো চক্ষুস্থির! মামার কাছে যতীনবাবুর এবং তার বাঁশি বাজানোর যে রকম উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছিলাম তাতে মনে হয়েছিল লোকটা নিশ্চয় একজন কেষ্টবিষ্টু গোছের কেউ হবেন। আর কেষ্টবিষ্টু গোছের একজন লোক যে বৈকুণ্ঠ বা মথুরার রাজপ্রাসাদ না হোক, অন্তত বেশ বড়ো আর ভদ্রচেহারা একটা বাড়িতে বাস করেন এও তো স্বতঃসিদ্ধ কথা। কিন্তু বাড়িটা যে গলিতে সেটার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, এ যে ইট-বার করা তিনকালের বুড়োর মতো নড়বড়ে একটা ইটের খাঁচা! সামনেটার চেহারাই যদি এ রকম, ভেতরটা না জানি কী রকম হবে।
উইয়ে ধরা দরজাব কড়া নাড়লাম।
একটু পরেই দরজা খুলে যে লোকটি সামনে এসে দাঁড়ালেন তাকে দেখে মনে হল ছাইগাদা নাড়তেই যেন একটা আগুন বার হয়ে পড়ল।
খুব রোগা। গায়ের রঙও অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবু একদিন চেহারাখানা কী রকম ছিল অনুমান করা শক্ত নয়। এখনও যা আছে, অপুর্ব!
বছর ত্রিশেক বয়স, কী কিছু কম? মলিন হয়ে আসা গায়ের রং অপূর্ব, শরীরের গড়ন অপূর্ব; মুখের চেহারা অপূর্ব। আর সব মিলিয়ে যে রূপ তাও অপূর্ব। সব চেয়ে অপূর্ব চোখ দুটি। চোখে চোখে চাইলে যেন নেশা লেগে যায়।
পুরুষেরও তা হলে সৌন্দর্য থাকে! ইট-বার-করা নোনা-ধরা দেয়াল আর উইয়ে-ধরা দরজা, তার মাঝখানে লোকটিকে দেখে আমার মনে হল ভারী সুন্দর একটা ছবিকে কে যেন অতি বিশ্রী একটা ফ্রেমে বাঁধিয়েছে।
বললেন, আমি ছাড়া তো বাড়িতে কেউ নেই, সুতরাং আমাকেই চান। কিন্তু কী চান?
আমার মুগ্ধ চিত্তে কে যেন একটা ঘা দিল। কী বিশ্ৰী গলার স্বর! কর্কশ! কথাগুলি মোলায়েম কিন্তু লোকটির গলার স্বর শুনে মনে হল যেন আমায় গালাগালি দিচ্ছেন। ভাবলাম, নির্দোষ সৃষ্টি বিধাতার কুষ্ঠিতে লেখে না। এমন চেহারায় ওই গলা! সৃষ্টিকর্তা যত বড়ো কারিগর হোন, কোথায় কী মানায় সে জ্ঞানটা তার একদম নেই।
বললাম, আপনার নাম তো যতীন্দ্রনাথ রায়? আমি হরেনবাবুর ভাগনে।
পরিচয়পত্রখানা বাড়িয়ে দিলাম।
এক নিশ্বাসে পড়ে বললেন, ইস! আবার পরিচয়পত্র কেন হে? হরেন যদি তোমার মামা, আমিও তোমার মামা। হরেন যে আমায় দাদা বলে ডাকে! এসো, এসো, ভেতরে এসো।
আমি ভেতরে ঢুকতে তিনি দরজা বন্ধ করলেন।
সদর দরজা থেকে দু-ধারের দেয়ালে গা ঠেকিয়ে হাত পাঁচেক এসে একটা হাত তিনেক চওড়া বারান্দায় পড়ে ডান দিকে বাঁকতে হল। বাঁদিকে বাঁকবার জো নেই, কারণ দেখা গেল সেদিকটা প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করা।
ছোট্ট একটু উঠান, বেশ পরিষ্কার। প্রত্যেক উঠানের চারটে করে পাশ থাকে, এটারও তাই আছে দেখলাম। দুপাশে দুখানা ঘর, এ বাড়িরই অঙ্গ। একটা দিক প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করা, অপর দিকে অন্য এক বাড়ির একটা ঘরের পেছন দিক জানালা দরজার চিহ্নমাত্র নেই, প্রাচীরেরই শামিল।
আমার নবলব্ধ মামা ডাকলেন, অতসী, আমার ভাগনে এসেছে, এ ঘরে একটা মাদুর বিছিয়ে দিয়ে যাও। ও ঘরটা বড়ো অন্ধকার!
এ-ঘর মানে আমরা যে ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। ও-ঘর মানে ওদিককার ঘরটা। সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক তরুণী, মস্ত ঘোমটায় মুখ ঢেকে।
যতীন মামা বললেন, এ কী! ঘোমটা কেন? আরে, এ যে ভাগনে!
মামির ঘোমটা ঘুচবার লক্ষণ নেই দেখে আবার বললেন, ছি ছি, মামি হয়ে ভাগনের কাছে ঘোমটা টেনে কলাবউ সাজবে?
এবার মামির ঘোমটা উঠল। দেখলাম, আমার নতুন পাওয়া মামিটি মামারই উপযুক্ত স্ত্রী বটে। মামি এ-ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে দিলেন। ঘরে তক্তপোশ, টেবিল, চেয়ার ইত্যাদির বালাই নেই। একপাশে একটা রং-চটা ট্রাঙ্ক আর একটা কাঠের বাকসো। দেয়ালে এক কোণ থেকে আর এক কোণ পর্যন্ত একটা দড়ি টাঙানো, তাতে একটি মাত্র ধুতি ঝুলছে। একটা পেরেকে একটা আধ ময়লা খদ্দরের পাঞ্জাবি লটকানো, যতীন মামার সম্পত্তি। গোটা দুই দু-বছর আগেকার ক্যালেন্ডারেব ছবি। একটাতে এখনও চৈত্রমাসের তারিখ লেখা কাগজটা লাগানো রয়েছে, ছিঁড়ে ফেলতে বোধ হয় কারও খেয়াল হয়নি।
যতীন মামা বললেন, একটু সুজিটুজি থাকে তো ভাগনেকে করে দাও। না থাকে এক কাপ চাই খাবেখন।
বললাম, কিছু দরকার নেই যতীন মামা। আপনার বাঁশি শুনতে এসেছি, বাঁশির সুরেই খিদে মিটবে এখন। যদিও খিদে পায়নি মোটেই, বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।
যতীন মামা বললেন, বাঁশি? বাঁশি তো এখন আমি বাজাই না।
বললাম, সে হবে না, আপনাকে শোনাতেই হবে।
বললেন, তা হলে বসো, রাত্রি হোক। সন্ধ্যার পর ছাড়া আমি বাঁশি ছুই না।