আদালতে নাফিস দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। অক্টোবরে ধরা পড়ার চার মাসের মধ্যেই (৭ই ফেব্রুয়ারি) আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন নাফিস। তিনি স্বীকারোক্তিতে বলেন, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত তিনি তছনছ করে দিতে চেয়েছিলেন। আর এ লক্ষ্যেই তিনি বিস্ফোরক ভর্তি ভ্যানের সাহায্যে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। নাফিস আদালতে বলেছিলেন, শিক্ষা ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগেই তিনি ওসামা বিন লাদেনের অনুসারী হন এবং সন্ত্রাসী হামলার সিদ্ধান্ত নেন। যুক্তরাষ্ট্রের আদালত আগস্ট মাসে নাফিসকে ৩০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।
নাফিসের ঘটনাটা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রচণ্ড ভাবে নাড়া দিয়েছিল। হয়তো আমি আমেরিকায় বাস করি বলেই। কিংবা এই প্রথম আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশী এক তরুণকে সন্ত্রাসবাদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া খবরে সয়লাব হতে দেখেছিলাম বলেই হয়তো ব্যাপারটা এমন ভাবে নাড়া দিয়েছিল আমায়। আসলে সত্য বলতে কি– একটা প্রশ্ন বরাবরই আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে। কেন এই সব তরুণ যুবকরা কেন সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নিচ্ছে, কখনোবা হয়ে উঠছে আত্মঘাতী? ঘটনা তো একটা দুটো নয়, সারা বিশ্ব জুড়েই ঘটে চলেছে শত শত।
পাঠকদের মনে আছে বোধ হয়, আমেরিকায় ২০০১ সালে ৯-১১ এর তাণ্ডবলীলা শেষ হতে না হতেই ২০০৫ সালে লন্ডনের পাতাল রেলে ঘটেছিল ৭/৭ এর ঘটনা। নাফিসের তরুণ বয়স দেখে অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন। ভেবেছেন, এতো ছোট ছেলের পক্ষে কি এতো বড় একটা অপরাধ করা সম্ভব? হা– বয়স একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু আমরা ভুলে যাই, লন্ডনের পাতাল রেলে বিস্ফোরণের সাথে জড়িত আত্মঘাতী চার তরুণের সবার বয়সই ছিল ত্রিশের কম। সর্বকনিষ্ঠ হাসিব হুসাইন ছিলেন মাত্র ১৮ বছরের তরুণ। আর শুধু আমেরিকা বা লন্ডনই বা বলি কেন, বাংলাদেশেই কি আমরা খালেদা-নিজামী জামানায় বাংলা ভাইয়ের তাণ্ডব দেখিনি? দেখিনি ইসলামের নামে দেশের প্রতিটি জেলায় বোমাবাজি, কিংবা রমনা বটমূল কিংবা সিনেমা হলের মতো ‘বেশরিয়তী জায়গাগুলোর উপর আগ্রাসন? দেখিনি চট্টগ্রাম আদালতে আত্মঘাতী বোমার তাণ্ডবে জগন্নাথ পাঁড়ের মৃত্যু? দেখিনি পত্রিকার পাতায় ঘাতকাহত হুমায়ুন আজাদের রক্তাক্ত ছবি? এগুলোর ভিত্তি কী? ২০০৫ সালের পর শুধু মুম্বাইয়েই সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে অন্তত: দশটি, যেগুলোর সাথে ইসলামী সন্ত্রাসবাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলে মনে করা হয়। এর আগে আমরা রাম-জন্মভূমিকে ইস্যু করে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সন্ত্রাস, বাবরি মসজিদ ধ্বংস কিংবা গুজরাটে দাঙ্গাও দেখেছি আমরা। এগুলোরই বা কারণ কী? এ ধরণের ঘটনা ঘটলেই খুব জোরে সোরে একটি কারণকে সামনে নিয়ে আসা হয়— ‘বিদ্যমান সামাজিক অনাচার’। ২০০১ সালে ১১ই সেপ্টেম্বরের রক্তাক্ত ঘটনার পর পরই বাম ভাবাদর্শে বিশ্বাসী প্রখ্যাত আমেরিকান রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোম চমস্কি বলেছিলেন, “আমেরিকা নিজেই এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র, যার কর্মকাণ্ডই নাইন-ইলেভেনকে নিজের উপর টেনে এনেছে’[১৭]। তবে সব বিশ্লেষকই যে চমস্কির ঢালাও মন্তব্যের সাথে একমত হয়েছেন তা নয়। যেমন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রুস লিঙ্কন তার Holy Terrors, Thinking About Religion After September 11’ গ্রন্থে পরিষ্কার করেই বলেছেন[১৮]—
‘ধর্মের কারণেই আতা এবং তাদের অন্যান্য সহযোগীরা মনে করেছে এ ধরনের আক্রমণ শুধু নৈতিক নয়, সেই সাথে পবিত্র দায়িত্ব।
আতা নিজেও তার সুটকেসে কোরআন বহন করছিলো। ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধারকৃত শেষ নির্দেশাবলীও সেই সাক্ষ্যই দেয়, যে তারা পবিত্র আল্লাহ এবং ইসলামের প্রেরণাতেই এই জিহাদে অংশ নিয়েছিলো। সেই নির্দেশাবলীতে আতা খুব গুরুত্ব দিয়েই বলেছিলো– কীভাবে আল্লাহর নামে যাত্রা শুরু করতে হবে, কীভাবে অস্ত্র তৈরি রাখতে হবে, কীভাবে নিজের দেহকে কোরআনের আয়াত দিয়ে আশীর্বাদধন্য করে নিতে হবে, কীভাবে ঘটনা ঘটানোর সময় সুরা পাঠ করে যেতে হবে ইত্যাদি[১৯]।
‘পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোর প্রভাব সাধারণ মানুষদের কাছে ব্যাপক, এমনকি এই আধুনিক সমাজেও। সেজন্যই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোর অমানবিক আয়াত কিংবা শ্লোকগুলো সন্ত্রাস এবং সহিংসতাকে উস্কে দিতে পারে। সহিংসতার সাথে যে ধর্মের বাণীর অনেক সময়ই সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকে তার ব্যাখ্যা জ্যাক নেলসন প্যালমেয়ার দিয়েছেন তার ইজ রিলিজিয়ন কিলিং আস?’ গ্রন্থে[২০]। তিনি বলেন,–
‘সহিংসতা ব্যাপারটা ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য কারণ, পবিত্র বাণীগুলোতে এর অনুমোদন পাওয়া যায় এবং সহিংস সমাজগুলোতে এগুলোর ব্যবহার যৌক্তিক বলে মনে করা হয়’।
একই ধরনের কথা বলেছেন মুক্তচিন্তক স্যাম হ্যারিস তার নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার ‘End of Faith’ গ্রন্থে[২১]। তিনি তার বইয়ে দেখিয়েছেন, অতিমাত্রায় মধ্যযুগীয় বিশ্বাস নির্ভরতার কারণেই সন্ত্রাস আর জিহাদ এখনো করাল গ্রাসের মত থাবা বসিয়ে আছে আমাদের সমাজে।
বিশ্বাস নির্ভর সন্ত্রাসবাদ এত ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে কোন নৃতাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক কিংবা জৈববৈজ্ঞানিক কারণ আছে কিনা তা খুঁজে দেখা আসলেই আমি জরুরী মনে করি। আমি দুবছর আগে ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামে একটা বই লিখেছিলাম সহলেখক রায়হান আবীরের সাথে মিলে[২২]। বইটির ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ অধ্যায়ে সামাজিক জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটি আলোচনা করেছিলাম। আলোচনাটি এখানেও প্রাসঙ্গিক মনে করছি।